Subscribe For Free Updates!

We'll not spam mate! We promise.

Thursday 13 November 2014

উৎসর্গ

উৎসর্গ    


রেভারেণ্ড্‌ সি. এফ. এণ্ড্‌রুজ
প্রিয়বন্ধুবরেষু


  শান্তিনিকেতন, ১লা বৈশাখ, ১৩২১
 

   


ভোরের পাখি ডাকে কোথায়
      ভোরের পাখি ডাকে।
ভোর না হতে ভোরের খবর
      কেমন করে রাখে।
এখনো যে আঁধার নিশি
জড়িয়ে আছে সকল দিশি
কালীবরন পুচ্ছ ডোরের
      হাজার লক্ষ পাকে।
ঘুমিয়ে-পড়া বনের কোণে
      পাখি কোথায় ডাকে।

ওগো তুমি ভোরের পাখি,
      ভোরের ছোটো পাখি,
কোন্‌ অরুণের আভাস পেয়ে
      মেল' তোমার আঁখি।
কোমল তোমার পাখার 'পরে
সোনার রেখা স্তরে স্তরে,
বাঁধা আছে ডানায় তোমার
      উষার রাঙা রাখি।
ওগো তুমি ভোরের পাখি,
      ভোরের ছোটো পাখি।

রয়েছে বট, শতেক জটা
      ঝুলছে মাটি ব্যেপে,
পাতার উপর পাতার ঘটা
      উঠছে ফুলে ফেঁপে।
তাহারি কোন্‌ কোণের শাখে
নিদ্রাহারা ঝিঁঝির ডাকে
বাঁকিয়ে গ্রীবা ঘুমিয়েছিলে
      পাখাতে মুখ ঝেঁপে,
যেখানে বট দাঁড়িয়ে একা
      জটায় মাটি ব্যেপে।

ওগো ভোরের সরল পাখি,
      কহো আমায় কহো--
ছায়ায় ঢাকা দ্বিগুণ রাতে
      ঘুমিয়ে যখন রহ,
হঠাৎ তোমার কুলায়-'পরে
কেমন ক'রে প্রবেশ করে
আকাশ হতে আঁধার-পথে
      আলোর বার্তাবহ।
ওগো ভোরের সরল পাখি
      কহো আমায় কহো!

কোমল তোমার বুকের তলে
      রক্ত নেচে উঠে,
উড়বে ব'লে পুলক জাগে
      তোমার পক্ষপুটে।
চক্ষু মেলি পুবের পানে
নিদ্রা-ভাঙা নবীন গানে
অকুণ্ঠিত কণ্ঠ তোমার
      উৎস-সমান ছুটে।
কোমল তোমার বুকের তলে
      রক্ত নেচে উঠে।

এত আঁধার-মাঝে তোমার
      এতই অসংশয়!
বিশ্বজনে কেহই তোরে
      করে না প্রত্যয়।
তুমি ডাক,"দাঁড়াও পথে,
সূর্য আসেন স্বর্ণরথে--
রাত্রি নয়, রাত্রি নয়,
      রাত্রি নয় নয়।'
এত আঁধার-মাঝে তোমার
      এতই অসংশয়!

আনন্দেতে জাগো আজি
      আনন্দেতে জাগো।
ভোরের পাখি ডাকে যে ওই
      তন্দ্রা এখন না গো।
প্রথম আলো পড়ুক মাথায়,
নিদ্রা-ভাঙা আঁখির পাতায়,
জ্যোতির্ময়ী উদয়-দেবীর
      আশীর্বচন মাগো।
ভোরের পাখি গাহিছে ওই,
      আনন্দেতে জাগো।


  হাজারিবাগ, ১১ চৈত্র, ১৩০৯
 

   


কেবল তব মুখের পানে
     চাহিয়া,
বাহির হনু তিমির-রাতে
  তরণীখানি বাহিয়া।
  অরুণ আজি উঠেছে--
  আশোক আজি ফুটেছে--
না যদি উঠে,না যদি ফুটে,
তবুও আমি চলিব ছুটে
  তোমার মুখে চাহিয়া।

নয়নপাতে ডেকেছ মোরে
      নীরবে।
হৃদয় মোর নিমেষ-মাঝে
    উঠেছে ভরি গরবে।
    শঙ্খ তব বাজিল--
    সোনার তরী সাজিল--
না যদি বাজে, না যদি সাজে,
গরব যদি টুটে গো লাজে
    চলিব তবু নীরবে।

কথাটি আমি শুধাব নাকো
      তোমারে।
দাঁড়াব নাকো ক্ষণেক-তরে
  দ্বিধার ভরে দুয়ারে।
  বাতাসে পাল ফুলিছে--
  পতাকা আজি দুলিছে--
না যদি ফুলে, না যদি দুলে,
তরণী যদি না লাগে কূলে
  শুধাব নাকো তোমারে।

   


মোর কিছু ধন আছে সংসারে,
     বাকি সব ধন স্বপনে
        নিভৃতস্বপনে।
ওগো কোথা মোর আশার অতীত,
ওগো কোথা তুমি পরশচকিত,
      কোথা গো স্বপনবিহারী।
তুমি এসো এসো গভীর গোপনে,
এসো গো নিবিড় নীরব চরণে
      বসনে প্রদীপ নিবারি,
       এসো গো গোপনে।
মোর কিছু ধন আছে সংসারে
বাকি সব আছে স্বপনে  
      নিভৃত  স্বপনে।

রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি,
      পথ ভরিয়াছে আলোকে
          প্রখর  আলোকে।
সবার অজানা, হে মোর বিদেশী,
তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী,
      হে মোর স্বপনবিহারী।
তোমারে চিনিব প্রাণের পুলকে,
চিনিব সজল আঁখির পলকে,
      চিনিব বিরলে নেহারি
         পরমপুলকে।
এসো প্রদোষের ছায়াতল দিয়ে,
      এসো না পথের আলোকে
           প্রখরআলোকে।

   


তোমারে পাছে সহজে বুঝি
      তাই কি এত লীলার ছল,
বাহিরে যবে হাসির ছটা
      ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব  
           ছলনা,
যে কথা তুমি বলিতে চাও
      সে কথা তুমি বল না।

তোমারে পাছে সহজে ধরি
      কিছুরই তব কিনারা নাই--
দশের দলে টানি গো পাছে
      বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
           ছলনা,
যে পথে তুমি চলিতে চাও
      সে পথে তুমি চল না।

সবার চেয়ে অধিক চাহ
      তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও--
হেলার ভরে খেলার মতো
      ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও।
বুঝেছি আমি বুঝেছি তব
           ছলনা,
সবার যাহে তৃপ্তি হল
      তোমার তাহে হল না।


   


আপনারে তুমি করিবে গোপন
        কী করি।
হৃদয় তোমার আঁখির পাতায়
     থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি।
আজ আসিয়াছ কৌতুকবেশে,
মানিকের হার পরি এলোকেশে,
নয়নের কোণে আধো হাসি হেসে
     এসেছ হৃদয়পুলিনে।
ভুলি নে তোমার বাঁকা কটাক্ষে,
ভুলি নে চতুর নিঠুর বাক্যে
        ভুলি নে।
করপল্লবে দিলে যে আঘাত
করিব কি তাহে আঁখিজলপাত।
      এমন অবোধ নহি গো।
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
        সহি গো।

আজ এই বেশে এসেছ আমায়
       ভুলাতে।
কভু কি আস নি দীপ্ত ললাটে
      স্নিগ্ধ পরশ বুলাতে।
দেখেছি তোমার মুখ কথাহারা--
জলে-ছলছল ম্লান আঁখিতারা,
দেখেছি তোমার ভয়-ভরে সারা
      করুণ পেলব মুরতি।
দেখেছি তোমার বেদনাবিধুর
পলকবিহীন নয়নে মধুর
        মিনতি।
আজি হাসিমাখা নিপুণ শাসনে
তরাস আমি যে পাব মনে মনে
      এমন অবোধ নহি গো
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
        সহি গো।

   


তোমায়     চিনি বলে আমি করেছি গরব
                লোকের মাঝে;
           মোর আঁকা পটে দেখেছে তোমায়
                অনেকে অনেক সাজে।
           কত জনে এসে মোরে ডেকে কয়
           "কে গো সে', শুধায় তব পরিচয়--
                      "কে গো সে।'
           তখন কী কই, নাহি আসে বাণী,
           আমি শুধু বলি,"কী জানি! কী জানি!'
           তুমি শুনে হাস, তারা দুষে মোরে
                      কী দোষে।

তোমার     অনেক কাহিনী গাহিয়াছি আমি
                 অনেক গানে।
           গোপন বারতা লুকায়ে রাখিতে
                 পারি নি আপন প্রাণে।
           কত জন মোরে ডাকিয়া কয়েছে,
           "যা গাহিছ তার অর্থ রয়েছে
                    কিছু কি।'
           তখন কী কই, নাহি আসে বাণী,
           আমি শুধু বলি,"অর্থ কী জানি!'
           তারা হেসে যায়,তুমি হাস বসে
                      মুচুকি।

তোমায়     জানি না চিনি না এ কথা বলো তো
                  কেমনে বলি।
           খনে খনে তুমি উঁকি মারি চাও,
                   খনে খনে যাও ছলি।
           জ্যোৎস্নানিশীথে পূর্ণ শশীতে
           দেখেছি তোমার ঘোমটা খসিতে,
           আঁখির পলকে পেয়েছি তোমায়
                      লখিতে।
           বক্ষ সহসা উঠিয়াছে দুলি,
           অকারণে আঁখি উঠেছে আকুলি,
           বুঝেছি হৃদয়ে ফেলেছ চরণ
                      চকিতে।

তোমায়     খনে খনে আমি বাঁধিতে চেয়েছি
                   কথার ডোরে।
           চিরকাল-তরে গানের সুরেতে
                   রাখিতে চেয়েছি ধরে।
           সোনার ছন্দে পাতিয়াছি ফাঁদ,
           বাঁশিতে ভরেছি কোমল নিখাদ,
           তবু সংশয় জাগে ধরা তুমি
                       দিলে কি!
           কাজ নাই,তুমি যা খুশি তা করো--
           ধরা না'ই দাও মোর মন হরো,
           চিনি বা না চিনি প্রাণ উঠে যেন
                      পুলকি।



   


পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
       আপন গন্ধে মম
       কস্তুরীমৃগসম।
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে
       কোথা দিশা খুঁজে পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
      যাহা পাই তাহা চাই না।

বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
      আপন বাসনা মম
      ফিরে মরীচিকাসম।
বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে
      বক্ষে ফিরিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
      যাহা পাই তাহা চাই না।

নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে
     চাহে যেন বাঁশি মম
     উতলা পাগলসম।
যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর
     রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
     যাহা পাই তাহা চাই না।


   


আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
        দিন চলে যায়, আমি আনমনে
        তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে,
        ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার
              পরশ পাবার প্রয়াসী।
              আমি সুদূরের পিয়াসি।
ওগো             সুদূর,বিপুল সুদূর,  তুমি যে
                         বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
                 মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই,
                        সে কথা যে যাই পাসরি।

আমি উৎসুক হে,
হে সুদূর, আমি প্রবাসী।
        তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো
        কী কথা আমায় শুনাও সতত।
        তব ভাষা শুনে তোমারে হৃদয়
              জেনেছে তাহার স্বভাষী।
                 হে সুদূর,আমি প্রবাসী।
     ওগো         সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে
                         বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
                 নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ
                      সে কথা যে যাই পাসরি। '

আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর,আমি উদাসী।
        রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায়
        তরুমর্মরে, ছায়ার খেলায়,
       কী মুরতি তব নীলাকাশশায়ী
            নয়নে উঠে গো আভাসি।
            হে সুদূর,আমি উদাসী।
ওগো            সুদূর, বিপুল সুদূর,  তুমি যে
                    বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
                 কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার
                    সে কথা যে যাই পাসরি।


   


        কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে--
                 কাঁদিছে আপন মনে,
             কুসুমের দলে বন্ধ হয়ে
                 করুণ কাতর স্বনে।
                 কহিছে সে,"হায় হায়,
             বেলা যায় বেলা যায় গো
                  ফাগুনের বেলা যায়।'
          ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
                   কিছু নাই তোর ভাবনা।
                কুসুম ফুটিবে, বাঁধন টুটিবে,
                 পুরিবে সকল কামনা।
             নিঃশেষ হয়ে যাবি যবে তুই
                 ফাগুন তখনো যাবে না।

       কুঁড়ির ভিতরে ফিরিছে গন্ধ কিসের আশে--
                   ফিরিছে আপনমাঝে,
                বাহিরিতে চায় আকুল শ্বাসে
                   কী জানি কিসের কাজে।
       কহিছে সে,"হায় হায়,
     কোথা আমি যাই,কারে চাই গো
        না জানিয়া দিন যায়।'
ভয় নাই তোর,ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
            কিছু নাই তোর ভাবনা।
     দখিনপবন দ্বারে দিয়া কান
          জেনেছে রে তোর না কামনা।
     আপনারে তোর না করিয়া ভোর
          দিন তোর চলে যাবে না।

কুঁড়ির ভিতরে আকুল গন্ধ ভাবিছে বসে--
            ভাবিছে উদাসপারা,
      "জীবন আমার কাহার দোষে
          এমন অর্থহারা।'
          কহিছে সে,"হায় হায়,
       কেন আমি বাঁচি,কেন আছি গো
           অর্থ না বুঝা যায়।'
ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
       কিছু নাই তোর ভাবনা।
যে শুভ প্রভাতে সকলের সাথে
           মিলিবি, পুরাবি কামনা,
আপন অর্থ সেদিন বুঝিবি--
          জনম ব্যর্থ যাবে না।



১০    


আমার মাঝারে যে আছে কে গো সে
       কোন্‌ বিরহিণী নারী?
আপন করিতে চাহিনু তাহারে,
       কিছুতেই নাহি পারি।
      রমণীরে কে বা জানে--
      মন তার কোন্‌খানে।
সেবা করিলাম দিবানিশি তার,
গাঁথি দিনু গলে কত ফুলহার,
মনে হল সুখে প্রসন্নমুখে
      চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়,একদিন হায়
      ফেলিল নয়নবারি--
"তোমাতে আমার কোনো সুখ নাই'
      কহে বিরহিণী নারী।

রতনে জড়িত নূপুর তাহারে
      পরায়ে দিলাম পায়ে,
রজনী জাগিয়া ব্যজন করিনু
      চন্দন-ভিজা বায়ে।
      রমণীরে কে বা জানে--
      মন তার কোন্‌খানে।
কনকখচিত পালঙ্ক'পরে
বসানু তাহারে বহু সমাদরে,
মনে হল হেন হাসিমুখে যেন
      চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়, লুটায়ে ধুলায়
      ফেলিল নয়নবারি--
"এ-সবে আমার কোনো সুখ নাই'
      কহে বিরহিণী নারী।

বাহিরে আনিনু তাহারে, করিতে
      হৃদয়দিগ্‌বিজয়।
সারথি হইয়া রথখানি তার
      চালানু ধরণীময়।
      রমণীরে কে বা জানে--
      মন তার কোন্‌খানে।
দিকে দিকে লোক সঁপি দিল প্রাণ,
দিকে দিকে তার উঠে চাটুগান,
মনে হল তবে দীপ্ত গরবে
      চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়,মুখ সে ফিরায়,
      ফেলে সে নয়নবারি--
"হৃদয় কুড়ায়ে কোনো সুখ নাই'
      কহে বিরহিণী নারী।

আমি কহিলাম,"কারে তুমি চাও
      ওগো বিরহিণী নারী।'
সে কহিল,"আমি যারে চাই,তার
      নাম না কহিতে পারি।'
      রমণীরে কে বা জানে--
      মন তার কোন্‌খানে।
সে কহিল,"আমি যারে চাই তারে
পলকে যদি গো পাই দেখিবারে,
পুলকে তখনি লব তারে চিনি
      চাহি তার মুখপানে।'
দিন চলে যায়, সে কেবল হায়
      ফেলে নয়নের বারি--
অজানারে কবে আপন করিব'
      কহে বিরহিণী নারী।

১১    


না জানি কারে দেখিয়াছি,
                 দেখেছি কার মুখ।
      প্রভাতে আজ পেয়েছি তার চিঠি।
পেয়েছি তাই সুখে আছি,
                 পেয়েছি এই সুখ--
      কারেও আমি দেখাব নাকো সেটি।
লিখন আমি নাহিকো জানি--
বুঝি না কী যে রয়েছে বাণী--
      যা আছে থাক্‌ আমার থাক্‌ তাহা।
পেয়েছি এই সুখে আজি
পবনে উঠে বাঁশরি বাজি,
       পেয়েছি সুখে পরান গাহে "আহা'।

পণ্ডিত সে কোথা আছে,
                 শুনেছি নাকি তিনি
     পড়িয়া দেন লিখন নানামতো।
যাব না আমি তাঁর কাছে,
                তাঁহারে নাহি চিনি,
     থাকুন লয়ে পুরানো পুঁথি যত।
শুনিয়া কথা পাব না দিশে,
বুঝেন কিনা বুঝিব কিসে,
       ধন্দ লয়ে পড়িব মহা গোলে।
তাহার চেয়ে এ লিপিখানি
মাথায় কভু রাখিব আনি
       যতনে কভু তুলিব ধরি কোলে।

রজনী যবে আঁধারিয়া
                আসিবে চারি ধারে,
      গগনে যবে উঠিবে গ্রহতারা;
ধরিব লিপি প্রসারিয়া
              বসিয়া গৃহদ্বারে--
      পুলকে রব হয়ে পলকহারা
তখন নদী চলিবে বাহি
যা আছে লেখা তাহাই গাহি,
      লিপির গান গাবে বনের পাতা--
আকাশ হতে সপ্তঋষি
গাহিবে ভেদি গহন নিশি
      গভীর তানে গোপন এই গাথা।

বুঝি না-বুঝি ক্ষতি কিবা,
              রব অবোধসম।
      পেয়েছি যাহা কে লবে তাহা কাড়ি।
রয়েছে যাহা নিশিদিবা
              রহিবে তাহা মম,
      বুকের ধন যাবে না বুক ছাড়ি।
খুঁজিতে গিয়া বৃথাই খুঁজি,
বুঝিতে গিয়া ভুল যে বুঝি,
      ঘুরিতে গিয়া কাছেরে করি দূর।
না-বোঝা মোর লিখনখানি
প্রাণের বোঝা ফেলিল টানি,
      সকল গানে লাগায়ে দিল সুর।


  হাজারিবাগ, ১১ চৈত্র, ১৩০৯
 

১২    


"হায়    গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা
ওগো   তপন তোমার স্বপন দেখি যে,করিতে পারি নে সেবা।'
                  শিশির কহিল কাঁদিয়া,
                  "তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া
          হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল।
          তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।'
        

"আমি    বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো,
তবু    শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি
          বাসিতে পারি যে ভালো।'
          শিশিরের বুকে আসিয়া
          কহিল তপন হাসিয়া,
"ছোটো হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি,
      তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব
          হাসির মতন করি।'

১৩    


              আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে
                      তোমারেই ভালোবেসেছি।
              জনতা বাহিয়া চিরদিন ধরে
                  শুধু তুমি আমি এসেছি।
                  দেখি চারি দিক-পানে
                  কী যে জেগে ওঠে প্রাণে--
              তোমার আমার অসীম মিলন
                  যেন গো সকল খানে।
              কত যুগ এই আকাশে যাপিনু
                  সে কথা অনেক ভুলেছি।
              তারায় তারায় যে আলো কাঁপিছে
                  সে আলোকে দোঁহে দুলেছি।

              তৃণরোমাঞ্চ ধরণীর পানে
                  আশ্বিনে নব আলোকে
              চেয়ে দেখি যবে আপনার মনে
                  প্রাণ ভরি উঠে পুলকে।
                  মনে হয় যেন জানি
                  এই অকথিত বাণী,
মূক মেদিনীর মর্মের মাঝে
          জাগিছে সে ভাবখানি।
এই প্রাণে-ভরা মাটির ভিতরে
          কত যুগ মোরা যেপেছি,
কত শরতের সোনার আলোকে
          কত তৃণে দোঁহে কেঁপেছি।

প্রাচীন কালের পড়ি ইতিহাস
          সুখের দুখের কাহিনী--
পরিচিতসম বেজে ওঠে সেই
          অতীতের যত রাগিণী।
          পুরাতন সেই গীতি
          সে যেন আমার স্মৃতি,
          কোন্‌ ভাণ্ডারে সঞ্চয় তার
          গোপনে রয়েছে নিতি।
প্রাণে তাহা কত মুদিয়া রয়েছে
          কত বা উঠিছে মেলিয়া--
পিতামহদের জীবনে আমরা
          দুজনে এসেছি খেলিয়া।

লক্ষ বরষ আগে যে প্রভাত
          উঠেছিল এই ভুবনে
তাহার অরুণকিরণকণিকা
          গাঁথ নি কি মোর জীবনে?
          সে প্রভাতে কোন্‌খানে
          জেগেছিনু কেবা জানে।
কী মুরতি-মাঝে ফুটালে আমারে
          সেদিন লুকায়ে প্রাণে!
হে চির-পুরানো,চিরকাল মোরে
          গড়িছ নূতন করিয়া।
চিরদিন তুমি সাথে ছিলে মোর,
          রবে চিরদিন ধরিয়া।

১৪    


সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি
      সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।
দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি
      সেই দেশ লব যুঝিয়া।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই--
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই
      সন্ধান লব বুঝিয়া।
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়,
      তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।

রহিয়া রহিয়া নব বসন্তে
      ফুলসুগন্ধ গগনে
কেঁদে ফেরে হিয়া মিলনবিহীন
      মিলনের শুভ লগনে।
আপনার যারা আছে চারি ভিতে
পারি নি তাদের আপন করিতে,
তারা নিশিদিশি জাগাইছে চিতে
      বিরহবেদনা সঘনে।
পাশে আছে যারা তাদেরই হারায়ে
      ফিরে প্রাণ সারা গগনে।

তৃণে পুলকিত যে মাটির ধরা
      লুটায় আমার সামনে--
সে আমায় ডাকে এমন করিয়া
      কেন যে,কব তা কেমনে।
মনে হয় যেন সে ধূলির তলে
যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে,
সে দুয়ার খুলি কবে কোন্‌ ছলে
      বাহির হয়েছি ভ্রমণে।
সেই মূক মাটি মোর মুখ চেয়ে
      লুটায় আমার সামনে।

নিশার আকাশ কেমন করিয়া
      তাকায় আমার পানে সে।
লক্ষযোজন দূরের তারকা
      মোর নাম যেন জানে সে।
যে ভাষায় তারা করে কানাকানি
সাধ্য কী আর মনে তাহা আনি;
চিরদিবসের ভুলে-যাওয়া বাণী
      কোন্‌ কথা মনে আনে সে।
অনাদি উষায় বন্ধু আমার
      তাকায় আমার পানে সে।

এ সাত-মহলা ভবনে আমার
      চির-জনমের ভিটাতে
স্থলে জলে আমি হাজার বাঁধনে
      বাঁধা যে গিঁঠাতে গিঁঠাতে।
তবু হায় ভুলে যাই বারে বারে,
দূরে এসে ঘর চাই বাঁধিবারে,
আপনার বাঁধা ঘরেতে কি পারে
     ঘরের বাসনা মিটাতে।
প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায়
     চির-জনমের ভিটাতে।

যদি চিনি,যদি জানিবারে পাই,
     ধুলারেও মানি আপনা।
ছেটো বড়ো হীন সবার মাঝারে
     করি চিত্তের স্থাপনা।
হই যদি মাটি,হই যদি জল,
হই যদি তৃণ,হই ফুলফল,
জীব-সাথে যদি ফিরি ধরাতল
     কিছুতেই নাই ভাবনা।
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
     অন্তবিহীন আপনা।

বিশাল বিশ্বে চারি দিক হতে
     প্রতি কণা মোরে টানিছে।
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ
     শত কোটি কর হানিছে।
ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস।
মোর তরে জল দু হাত বাড়াস?
নিশ্বাসে বুকে পশিয়া বাতাস
     চির-আহ্বান আনিছে।
পর ভাবি যারে তারা বারে বারে        
     সবাই আমারে টানিছে।

আছে আছে প্রেম ধুলায় ধুলায়,
     আনন্দ আছে নিখিলে।
মিথ্যায় ঘেরে,ছোটো কণাটিরে
     তুচ্ছ করিয়া দেখিলে।
জগতের যত অণু রেণু সব
আপনার মাঝে অচল নীরব
বহিছে একটি চিরগৌরব--
     এ কথা না যদি শিখিলে
জীবনে মরণে ভয়ে ভয়ে তবে
     প্রবাসী ফিরিবে নিখিলে।

ধুলা-সাথে আমি ধুলা হয়ে রব
     সে গৌরবের চরণে।
ফুলমাঝে আমি হব ফুলদল
     তাঁর পূজারতি-বরণে।
যেথা যাই আর যেথায় চাহি রে
তিল ঠাঁই নাই তাঁহার বাহিরে,
প্রবাস কোথাও নাহি রে নাহি রে
     জনমে জনমে মরণে।
যাহা হই আমি তাই হয়ে রব
     সে গৌরবের চরণে।

ধন্য রে আমি অনন্ত কাল,
     ধন্য আমার ধরণী।
ধন্য এ মাটি,ধন্য সুদূর
     তারকা হিরণ-বরনী।
যেথা আছি আমি আছি তাঁরি দ্বারে,
নাহি জানি ত্রাণ কেন বল কারে।
আছে তাঁরি পারে তাঁরি পারাবারে
     বিপুল ভুবনতরণী।
যা হয়েছি আমি ধন্য হয়েছি,
     ধন্য এ মোর ধরণী।


  ৩ ফাল্গুন, ১৩০৭ 
 

১৫    


আকাশ-সিন্ধু-মাঝে এক ঠাঁই
      কিসের বাতাস লেগেছে--
      জগৎ-ঘূর্ণি জেগেছে।
ঝলকি উঠেছে রবি-শশাঙ্ক,
      ঝলকি ছুটেছে তারা,
অযুত চক্র ঘুরিয়া উঠেছে
      অবিরাম মাতোয়ারা।
স্থির আছে শুধু একটি বিন্দু
      ঘূর্ণির মাঝখানে--
সেইখান হতে স্বর্ণকমল
      উঠেছে শূন্যপানে।
      সুন্দরী, ওগো সুন্দরী,
শতদলদলে ভুবনলক্ষ্ণী
      দাঁড়ায়ে রয়েছ মরি মরি।
জগতের পাকে সকলি ঘুরিছে,
      অচল তোমার রূপরাশি।
নানা দিক হতে নানা দিন দেখি--
      পাই দেখিবারে ওই হাসি।

জনমে মরণে আলোকে আঁধারে
      চলেছি হরণে পূরণে,
      ঘুরিয়া চলেছি ঘুরনে।
কাছে যাই যার দেখিতে দেখিতে
      চলে যায় সেই দূরে,
হাতে পাই যারে পলক ফেলিতে
      তারে ছুঁয়ে যাই ঘুরে।
কোথাও থাকিতে না পারি ক্ষণেক,
      রাখিতে পারি নে কিছু--
মত্ত হৃদয় ছুটে চলে যায়
      ফেনপুঞ্জের পিছু।
      হে প্রেম, হে ধ্রুবসুন্দর,
স্থিরতার নীড় তুমি রচিয়াছ
      ঘূর্ণার পাকে খরতর।
দ্বীপগুলি তব গীতমুখরিত,
      ঝরে নির্ঝর কলভাষে,
অসীমের চির-চরম শান্তি
      নিমেষের মাঝে মনে আসে।

১৬    


হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি
     দেখা দিলে আজ কী বেশে।
দেখিনু তোমারে পূর্বগগনে,
     দেখিনু তোমারে স্বদেশে।
ললাট তোমার নীল নভতল
বিমল আলোকে চির-উজ্জ্বল
নীরব আশিস-সম হিমাচল
     তব বরাভয় কর।
সাগর তোমার পরশি চরণ
পদধূলি সদা করিছে হরণ,
জাহ্নবী তব হার-আভরণ
     দুলিছে বক্ষ'পর।
হৃদয় খুলিয়া চাহিনু বাহিরে,
     হেরিনু আজিকে নিমেষে--
মিলে গেছ ওগো বিশ্বদেবতা,
     মোর সনাতন স্বদেশে।

শুনিনু তোমার স্তবের মন্ত্র
      অতীতের তপোবনেতে--
অমর ঋষির হৃদয় ভেদিয়া
      ধ্বনিতেছে ত্রিভুবনেতে।
প্রভাতে হে দেব,তরুণ তপনে
দেখা দাও যবে উদয়গগনে
মুখ আপনার ঢাকি আবরণে
      হিরণ-কিরণে গাঁথা--
তখন ভারতে শুনি চারি ভিতে
মিলি কাননের বিহঙ্গগীতে
প্রাচীন নীরব কণ্ঠ হইতে
      উঠে গায়ত্রীগাথা।
হৃদয় খুলিয়া দাঁড়ানু বাহিরে
      শুনিনু আজিকে নিমেষে,
অতীত হইতে উঠিছে হে দেব,
      তব গান মোর স্বদেশে।

নয়ন মুদিয়া শুনিনু, জানি না
      কোন্‌ অনাগত বরষে
তব মঙ্গলশঙ্খ তুলিয়া
      বাজায় ভারত হরষে।
ডুবায়ে ধরার রণহুংকার
ভেদি বণিকের ধনঝংকার
মহাকাশতলে উঠে ওঙ্কার
      কোনো বাধা নাহি মানি।
ভারতের শ্বেত হৃদিশতদলে,
দাঁড়ায়ে ভারতী তব পদতলে,
সংগীততানে শূন্যে উথলে
      অপূর্ব মহাবাণী।
নয়ন মুদিয়া ভাবীকালপানে
      চাহিনু, শুনিনু নিমেষে
তব মঙ্গলবিজয়শঙ্খ
      বাজিছে আমার স্বদেশে।

১৭    


ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
      গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে,
      ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ,
      রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
      সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি,
      ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা,
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
      মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।

১৮    


তোমার বীণায় কত তার আছে
      কত-না সুরে,
আমি তার সাথে আমার তারটি
      দিব গো জুড়ে।
তার পর হতে প্রভাতে সাঁঝে
তব বিচিত্র রাগিণীমাঝে
আমারো হৃদয় রণিয়া রণিয়া
      বাজিবে তবে।
তোমার সুরেতে আমার পরান
      জড়ায়ে রবে।

তোমার তারায় মোর আশাদীপ
     রাখিব জ্বালি।
তোমার কুসুমে আমার বাসনা
     দিব গো ঢালি।
তার পর হতে নিশীথে প্রাতে
তব বিচিত্র শোভার সাথে
আমারো হৃদয় জ্বলিবে ফুটিবে,
     দুলিবে সুখে--
মোর পরানের ছায়াটি পড়িবে
     তোমার মুখে।

১৯    


     হে রাজন্‌,তুমি আমারে
বাঁশি বাজাবার দিয়েছ যে ভার
     তোমার সিংহদুয়ারে--
     ভুলি নাই তাহা ভুলি নাই,
     মাঝে মাঝে তবু ভুলে যাই,
চেয়ে চেয়ে দেখি কে আসে কে যায়
     কোথা হতে যায় কোথা রে।

     কেহ নাহি চায় থামিতে।
শিরে লয়ে বোঝা চলে যায় সোজা,
     না চাহে দখিনে বামেতে।
     বকুলের শাখে পাখি গায়,
     ফুল ফুটে তব আঙিনায়--
না দেখিতে পায়,না শুনিতে চায়,
     কোথা যায় কোন্‌ গ্রামেতে।

     বাঁশি লই আমি তুলিয়া।
তারা ক্ষণতরে পথের উপরে
      বোঝা ফেলে বসে ভুলিয়া।
      আছে যাহা চিরপুরাতন
      তারে পায় যেন হারাধন,
বলে, "ফুল এ কী ফুটিয়াছে দেখি।
      পাখি গায় প্রাণ খুলিয়া।'

      হে রাজন্‌,তুমি আমারে
রেখো চিরদিন বিরামবিহীন
      তোমার সিংহদুয়ারে।
      যারা কিছু নাহি কহে যায়,
      সুখদুখভার বহে যায়,
তারা  ক্ষণতরে বিস্ময়ভরে
      দাঁড়াবে পথের মাঝারে
      তোমার সিংহদুয়ারে।

২০    


    দুয়ারে তোমার ভিড় ক'রে যারা আছে,
ভিক্ষা তাদের চুকাইয়া দাও আগে।
    মোর নিবেদন নিভৃতে তোমার কাছে--
সেবক তোমার অধিক কিছু না মাগে।
    ভাঙিয়া এসেছি ভিক্ষাপাত্র,
    শুধু বীণাখানি রেখেছি মাত্র,
বসি এক ধারে পথের কিনারে
    বাজাই সে বীণা দিবসরাত্র।

    দেখো কতজন মাগিছে রতনধূলি,
কেহ আসিয়াছে যাচিতে নামের ঘটা--
    ভরি নিতে চাহে কেহ বিদ্যার ঝুলি,
কেহ ফিরে যাবে লয়ে বাক্যের ছটা।
আমি আনিয়াছি এ বীণাযন্ত্র,
    তব কাছে লব গানের মন্ত্র,
তুমি নিজ-হাতে বাঁধো এ বীণায়
    তোমার একটি স্বর্ণতন্ত্র।

  নগরের হাটে করিব না বেচাকেনা,
লোকালয়ে আমি লাগিব না কোনো কাজে।
  পাব না কিছুই,রাখিব না কারো দেনা,
অলস জীবন যাপিব গ্রামের মাঝে।
  তরুতলে বসি মন্দ-মন্দ
  ঝংকার দিব কত কী ছন্দ,
যত গান গাব তব বাঁধা তারে
  বাজিবে তোমার উদার মন্দ্র।

২১    


বাহির হইতে দেখো না এমন করে,
     আমায় দেখো না বাহিরে।
আমায় পাবে না আমার দুখে ও সুখে,
আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে,
আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে
    কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহি রে।

                সাগরে সাগরে কলরবে যাহা বাজে,
                মেঘগর্জনে ছুটে ঝঞ্ঝার মাঝে,
                নীরব মন্দ্রে নিশীথ-আকাশে রাজে
                      আঁধার হইতে আঁধারে আসন পাতিয়া--
                আমি সেই এই মানবের লোকালয়ে
                বাজিয়া উঠেছি সুখে দুখে লাজে ভয়ে,
                গরজি ছুটিয়া ধাই জয়ে পরাজয়ে
                      বিপুল ছন্দে উদার মন্দ্রে মাতিয়া।

যে গন্ধ কাঁপে ফুলের বুকের কাছে,
ভোরের আলোকে যে গান ঘুমায়ে আছে,
শারদ-ধান্যে যে আভা আভাসে নাচে
      কিরণে কিরণে হসিত হিরণে হরিতে,
সেই গন্ধই গড়েছে আমার কায়া,
সে গান আমাতে রচিছে নূতন মায়া,
সে আভা আমার নয়নে ফেলেছে ছায়া--
      আমার মাঝারে আমারে কে পারে ধরিতে।

            নর-অরণ্যে মর্মতান তুলি,
            যৌবনবনে উড়াই কুসুমধূলি,
            চিত্তগুহায় সুপ্ত রাগিণীগুলি,
                  শিহরিয়া উঠে আমার পরশে জাগিয়া।
            নবীন উষার তরুণ অরুণে থাকি
            গগনের কোণে মেলি পুলকিত আঁখি,
            নীরব প্রদোষে করুণ কিরণে ঢাকি
                  থাকি মানবের হৃদয়চূড়ায় লাগিয়া।

তোমাদের চোখে অঁখিজল ঝরে যবে
আমি তাহাদের গেঁথে দিই গীতরবে,
লাজুক হৃদয় যে কথাটি নাহি কবে
      সুরের ভিতরে লুকাইয়া কহি তাহারে।
নাহি জানি আমি কী পাখা লইয়া উড়ি,
খেলাই ভুলাই দুলাই ফুটাই কুঁড়ি,
কোথা হতে কোন্‌ গন্ধ যে করি চুরি
      সন্ধান তার বলিতে পারি না কাহারে।

            যে আমি স্বপন-মুরতি গোপনচারী,
            যে আমি আমারে বুঝিতে বুঝাতে নারি,
            আপন গানের কাছেতে আপনি হারি,
                  সেই আমি কবি। কে পারে আমারে ধরিতে।
     মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে,
     ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে,
     যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে,
           কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।

২২    


আছি আমি বিন্দুরূপে, হে অন্তরযামী
আছি আমি বিশ্বকেন্দ্রস্থলে। "আছি আমি'
এ কথা স্মরিলে মনে মহান্‌ বিস্ময়
আকুল করিয়া দেয়,স্তব্ধ এ হৃদয়
প্রকাণ্ড রহস্যভারে। "আছি আর আছে'
অন্তহীন আদি প্রহেলিকা, কার কাছে
শুধাইব অর্থ এর! তত্ত্ববিদ্‌ তাই
কহিতেছে,"এ নিখিলে আর কিছু নাই,
শুধু এক আছে।' করে তারা একাকার
অস্তিত্বরহস্যরাশি করি অস্বীকার।
একমাত্র তুমি জান এ ভবসংসারে
যে আদি গোপন তত্ত্ব, আমি কবি তারে
চিরকাল সবিনয়ে স্বীকার করিয়া
অপার বিস্ময়ে চিত্ত রাখিব ভরিয়া।

২৩    


          শূন্য ছিল মন,  
নানা-কোলাহলে-ঢাকা
নানা-আনাগোনা-আঁকা
          দিনের মতন।
নানা-জনতায়-ফাঁকা
          কর্মে-অচেতন
          শূন্য ছিল মন।

জানি না কখন এল নূপুরবিহীন
        নিঃশব্দ গোধূলি।
    দেখি নাই স্বর্ণরেখা
    কী লিখিল শেষ লেখা
        দিনান্তের তুলি।
    আমি যে ছিলাম একা
        তাও ছিনু ভুলি।
        আইল গোধূলি।

হেনকালে আকাশের বিস্ময়ের মতো
        কোন্‌ স্বর্গ হতে
    চাঁদখানি লয়ে হেসে
    শুক্লসন্ধ্যা এল ভেসে
          আঁধারের স্রোতে।
    বুঝি সে আপনি মেশে
          আপন আলোতে
          এল কোথা হতে।

অকস্মাৎ বিকশিত পুষ্পের পুলকে
          তুলিলাম আঁখি।
    আর কেহ কোথা নাই,
    সে শুধু আমারি ঠাঁই
          এসেছে একাকী।
    সম্মুখে দাঁড়ালো তাই
          মোর মুখে রাখি
          অনিমেষ আঁখি।

রাজহংস এসেছিল কোন্‌ যুগান্তরে
          শুনেছি পুরাণে।
     দময়ন্তী আলবালে
     স্বর্ণঘটে জল ঢালে
           নিকুঞ্জবিতানে,
     কার কথা হেনকালে
          কহি গেল কানে--
          শুনেছি পুরাণে।

জ্যোৎস্নাসন্ধ্যা তারি মতো আকাশ বাহিয়া
          এল মোর বুকে।
  কোন্‌ দূর প্রবাসের
  লিপিখানি আছে এর
        ভাষাহীন মুখে।
  সে যে কোন্‌ উৎসুকের
        মিলনকৌতুকে
        এল মোর বুকে।

দুইখানি শুভ্র ডানা ঘেরিল আমারে
        সর্বাঙ্গে হৃদয়ে।
  স্কন্ধে মোর রাখি শির
  নিস্পন্দ রহিল স্থির
        কথাটি না কয়ে।
  কোন্‌ পদ্মবনানীর
        কোমলতা লয়ে
        পশিল হৃদয়ে?

আর কিছু বুঝি নাই,শুধু বুঝিলাম
        আছি আমি একা।
  এই শুধু জানিলাম
  জানি নাই তার নাম
        লিপি যার লেখা।
     এই শুধু বুঝিলাম
          না পাইলে দেখা
          রব আমি একা।

ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় এ দিনরজনী,
          এ মোর জীবন!
     হায় হায়, চিরদিন
     হয়ে আছে অর্থহীন
          এ বিশ্বভুবন।
     অনন্ত প্রেমের ঋণ
          করিছে বহন
          ব্যর্থ এ জীবন।

ওগো দূত দূরবাসী, ওগো বাক্যহীন,
          হে সৌম্য-সুন্দর,
     চাহি তব মুখপানে
     ভাবিতেছি মুগ্ধপ্রাণে
          কী দিব উত্তর।
     অশ্রু আসে দু নয়ানে,
          নির্বাক্‌ অন্তর,
          হে সৌম্য-সুন্দর।

২৪    


হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সংগীত
তরঙ্গিয়া চলিয়াছে অনুদাত্ত উদাত্ত স্বরিত
প্রভাতের দ্বার হতে সন্ধ্যার পশ্চিমনীড়-পানে
দুর্গম দুরূহ পথে কী জানি কী বাণীর সন্ধানে!
দুঃসাধ্য উচ্ছ্বাস তব শেষ প্রান্তে উঠি আপনার
সহসা মুহূর্তে যেন হারায়ে ফেলেছে কণ্ঠ তার,
ভুলিয়া গিয়াছে সব সুর -- সামগীত শব্দহারা
নিয়ত চাহিয়া শূন্যে বরষিছে নির্ঝরিণীধারা।

হে গিরি,যৌবন তব যে দুর্দম অগ্নিতাপবেগে
আপনারে উৎসারিয়া মরিতে চাহিয়াছিল মেঘে
সে তাপ হারায়ে গেছে, সে প্রচণ্ড গতি অবসান --
নিরুদ্দেশ চেষ্টা তব হয়ে গেছে প্রাচীন পাষাণ।
পেয়েছ আপন সীমা, তাই আজি মৌন শান্ত হিয়া
সীমাবিহীনের মাঝে আপনারে দিয়েছ সঁপিয়া।


  আলমোড়া, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০ 
 
 

২৫    


ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে, তাই হেরো আজি
তোমার সর্বাঙ্গ ঘেরি পুলকিছে শ্যাম শস্পরাজি
প্রস্ফুটিত পুষ্পজালে; বনস্পতি শত বরষার
আনন্দবর্ষণকাব্য লিখিতেছে পত্রপুঞ্জে তার
বল্কলে শৈবালে জটে; সুদুর্গম তোমার শিখর
নির্ভয় বিহঙ্গ যত কলোল্লাসে করিছে মুখর।
আসি নরনারীদল তোমার বিপুল বক্ষপটে
নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি বাঁধিয়াছে নির্ঝরিণীতটে।
যেদিন উঠিয়াছিলে অগ্নিতেজে স্পর্ধিতে আকাশ,
কম্পমান ভূমণ্ডলে, চন্দ্রসূর্য করিবারে গ্রাস --
সেদিন হে গিরি, তব এক সঙ্গী আছিল প্রলয়;
যখনি থেমেছ তুমি, বলিয়াছ "আর নয় নয়',
চারি দিক হতে এল তোমা'পরে আনন্দনিশ্বাস,
তোমার সমাপ্তি ঘেরি বিস্তারিল বিশ্বের বিশ্বাস।


  জোড়াসাঁকো, ৯ আষাঢ়, ১৩১০ 
 
 

২৬    


আজি হেরিতেছি আমি, হে হিমাদ্রি, গভীর নির্জনে
পাঠকের মতো তুমি বসে আছ অচল আসনে,
সনাতন পুঁথিখানি তুলিয়া লয়েছ অঙ্ক'পরে।
পাষাণের পত্রগুলি খুলিয়া গিয়াছে থরে থরে,
পড়িতেছ একমনে। ভাঙিল গড়িল কত দেশ,
গেল এল কত যুগ-- পড়া তব হইল না শেষ।
আলোকের দৃষ্টিপথে এই-যে সহস্র খোলা পাতা
ইহাতে কি লেখা আছে ভব-ভবানীর প্রেম-গাথা--
নিরাসক্ত নিরাকাঙক্ষ ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বর
কেমনে দিলেন ধরা সুকোমল দুর্বল সুন্দর
বাহুর করুণ আকর্ষণে - কিছু নাহি চাহি যাঁর
তিনি কেন চাহিলেন-- ভালোবাসিলেন নির্বিকার--
পরিলেন পরিণয়পাশ। এই-যে প্রেমের লীলা
ইহারই কাহিনী বহে হে শৈল, তোমার যত শিলা।


  আলমোড়া, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০ 
 

২৭    


তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত
তপস্যার মতো। স্তব্ধ ভূমানন্দ যেন রোমাঞ্চিত
নিবিড় নিগূঢ়-ভাবের পথশূন্য তোমার নির্জনে,
নিষ্কলঙ্ক নীহারের অভ্রভেদী আত্মবিসর্জনে।
তোমার সহস্র শৃঙ্গ বাহু তুলি কহিছে নীরবে
ঋষির আশ্বাসবাণী, "শুন শুন বিশ্বজন সবে,
জেনেছি, জেনেছি আমি।' যে ওঙ্কার আনন্দ-আলোতে
উঠেছিল ভারতের বিরাট গভীর বক্ষ হতে
আদি-অন্ত-বিহীনের অখণ্ড অমৃতলোক-পানে,
সে আজি উঠিছে বাজি, গিরি, তব বিপুল পাষাণে।
একদিন এ ভারতে বনে বনে হোমাগ্নি-আহুতি
ভাষাহারা মহাবার্তা প্রকাশিতে করেছে আকূতি,
সেই বহ্নিবাণী আজি অচল প্রস্তরশিখারূপে
শৃঙ্গে শৃঙ্গে কোন্‌ মন্ত্র উচ্ছ্বাসিছে মেঘধুম্রস্তূপে।


  জোড়াসাঁকো, ৮ আষাঢ়, ১৩১০
 

২৮    


হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার
অভেদাঙ্গ হরগৌরী আপনারে যেন বারম্বার
শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিস্তারিয়া ধরিছেন বিচিত্র মুরতি।
ওই হেরি ধ্যানাসনে নিত্যকাল স্তব্ধ পশুপতি,
দুর্গম দুঃসহ মৌন-- জটাপুঞ্জতুষারসংঘাত
নিঃশব্দে গ্রহণ করে উদয়াস্তরবিরশ্মিপাত
পূজাস্বর্ণপদ্মদল। কঠিনপ্রস্তরকলেবর
মহান্‌-দরিদ্র, রিক্ত, আভরণহীন দিগম্বর,
হেরো তাঁরে অঙ্গে অঙ্গে এ কী লীলা করেছে বেষ্টন--
মৌনেরে ঘিরেছে গান, স্তব্ধেরে করেছে আলিঙ্গন
সফেন চঞ্চল নৃত্য, রিক্ত কঠিনেরে ওই চুমে
কোমল শ্যামলশোভা নিত্যনব পল্লবে কুসুমে
ছায়ারৌদ্রে মেঘের খেলায়। গিরিশেরে রয়েছেন ঘিরি
পার্বতী মাধুরীচ্ছবি তব শৈলগৃহে হিমগিরি।


  শান্তিনিকেতন, ৬ আষাঢ়, ১৩১০
 

২৯    


ভারতসমুদ্র তার বাষ্পোচ্ছ্বাস নিশ্বসে গগনে
আলোক করিয়া পান, উদাস দক্ষিণসমীরণে
অনির্বচনীয় যেন আনন্দের অব্যক্ত আবেগ।
উর্ধ্ববাহু হিমাচল, তুমি সেই উদ্বাহিত মেঘ
শিখরে শিখরে তব ছায়াচ্ছন্ন গুহায় গুহায়
রাখিছ নিরুদ্ধ করি-- পুনর্বার উন্মুক্ত ধারায়
নূতন আনন্দস্রোতে নব প্রাণে ফিরাইয়া দিতে
অসীমজিজ্ঞাসারত সেই মহাসমুদ্রের চিতে।
সেইমতো ভারতের হৃদয়সমুদ্র এতকাল
করিয়াছে উচ্চারণ ঊর্ধ্ব-পানে যে বাণী বিশাল,
অনন্তের জ্যোতিস্পর্শে অনন্তেরে যা দিয়েছে ফিরে,
রেখেছ সঞ্চয় করি হে হিমাদ্রি, তুমি স্তব্ধশিরে।
তব মৌন শৃঙ্গ-মাঝে তাই আমি ফিরি অন্বেষণে
ভারতের পরিচয় শান্ত-শিব-অদ্বৈতের সনে।


  জোড়াসাঁকো, ৯ আষাঢ়, ১৩১০
 

৩০    


ভারতের কোন্‌ বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি
হে আচার্য জগদীশ। কী অদৃশ্য তপোভূমি
বিরচিলে এ পাষাণনগরীর শুষ্ক ধূলিতলে।
কোথা পেলে সেই শান্তি এ উন্মত্ত জনকোলাহলে
যার তলে মগ্ন হয়ে মুহূর্তে বিশ্বের কেন্দ্র-মাঝে
দাঁড়াইলে একা তুমি-- এক যেথা একাকী বিরাজে
সূর্যচন্দ্র পুষ্পপত্র-পশুপক্ষী-ধুলায়-প্রস্তরে--
এক তন্দ্রাহীন প্রাণ নিত্য যেথা নিজ অঙ্ক-'পরে
দুলাইছে চরাচর নিঃশব্দ সংগীতে। মোরা যবে
মত্ত ছিনু অতীতের অতিদূর নিষ্ফল গৌরবে--
পরবস্ত্রে, পরবাক্যে, পরভঙ্গিমার ব্যঙ্গরূপে
কল্লোল করিতেছিনু স্ফীতকন্ঠে ক্ষুদ্র অন্ধকূপে--
তুমি ছিলে কোন্‌ দূরে। আপনার স্তব্ধ ধ্যানাসন
কোথায় পাতিয়াছিলে। সংযত গম্ভীর করি মন
ছিলে রত তপস্যায় অরূপরশ্মির অন্বেষণে
লোকলোকান্তের অন্তরালে -- যেথা পূর্ব ঋষিগণে
বহুত্বের সিংহদ্বার উদ্‌ঘাটিয়া একের সাক্ষাতে
দাঁড়াতেন বাক্যহীন স্তম্ভিত বিস্মিত জোড়হাতে।
হে তপস্বী, ডাকো তুমি সামমন্ত্রে জলদগর্জনে,
"উত্তিষ্ঠত নিবোধত!' ডাকো শাস্ত্র-অভিমানী জনে
পাণ্ডিত্যের পণ্ডতর্ক হতে। সুবৃহৎ বিশ্বতলে
ডাকো মূঢ় দাম্ভিকেরে। ডাক দাও তব শিষ্যদলে,
একত্রে দাঁড়াক তারা তব হোমহুতাগ্নি ঘিরিয়া।
আরবার এ ভারত আপনাতে আসুক ফিরিয়া
নিষ্ঠায়, শ্রদ্ধায়, ধ্যানে-- বসুক সে অপ্রমত্তচিতে
লোভহীন দ্বন্দ্বহীন শুদ্ধ শান্ত গুরুর বেদীতে

৩১    


আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো,
              দিক্‌-দিগন্ত ঢাকি।
আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,
              আমরা খাঁচার পাখি--
              হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
      আজি কি আসিল প্রলয়রাত্রি ঘোর।
      চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া।
      চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া?
দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?--
তোমাপানে চাই, কাঁদিয়া শুধাই আমরা খাঁচার পাখি।

ফাল্গুন এলে সহসা দখিনপবন হতে
              মাঝে মাঝে রহি রহি
আসিত সুবাস সুদূরকুঞ্জভবন হতে
              অপূর্ব আশা বহি।
              হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
      মাঝে মাঝে যবে রজনী হইত ভোর,
      কী মায়ামন্ত্রে বন্ধনদুখ নাশিয়া
      খাঁচার কোণেতে প্রভাত পশিত হাসিয়া
ঘনমসী-আঁকা লোহার শলাকা সোনার সুধায় মাখি।--
নিখিল বিশ্ব পাইতাম প্রাণে আমরা খাঁচার পাখি।

আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা
              কিছুই না যায় দেখা--
আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়া, হোথা
           পড়ে নি সোনার রেখা।
           হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
      আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর।
      আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে--
      কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি
সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।

ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন
           তোমারে না দেয় ব্যথা।
পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন
           লয়ে বৃথা আকুলতা।
           হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
      তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।
      সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,
      সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া--
"নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি' কহো আমাদের ডাকি,
মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি।

৩২    


যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী,
কবির বিচিত্র গান নিতে পার কাড়ি
আপন চরণপ্রান্তে; তুমি মুগ্ধচিতে
মগ্ন আছ আপনার গৃহের সংগীতে।
স্তবে তব নাহি কান, তাই স্তব করি,
তাই আমি ভক্ত তব, অনিন্দ্যসুন্দরী।
ভুবন তোমারে পূজে, জেনেও জান না;
ভক্তদাসীসম তুমি কর আরাধনা
খ্যাতিহীন প্রিয়জনে। রাজমহিমারে
যে করপরশে তব পার' করিবারে
দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে
ধূলি ঝাঁট দাও তুমি আপনার ঘরে।
সেই তো মহিমা তব, সেই তো গরিমা--
সকল মাধুর্য চেয়ে তারি মধুরিমা।

৩৩    


দেখো চেয়ে গিরির শিরে
মেঘ করেছে গগন ঘিরে,
      আর কোরো না দেরি।
ওগো আমার মনোহরণ,
ওগো স্নিগ্ধ ঘনবরন,
      দাঁড়াও, তোমায় হেরি।
দাঁড়াও গো ওই আকাশ-কোলে,
দাঁড়াও আমার হৃদয়-দোলে,
      দাঁড়াও গো ওই শ্যামল-তৃণ-'পরে,
আকুল চোখের বারি বেয়ে
দাঁড়াও আমার নয়ন ছেয়ে,
      জন্মে জন্মে যুগে যুগান্তরে।
অমনি করে ঘনিয়ে তুমি এসো,
অমনি করে তড়িৎ-হাসি হেসো,
      অমনি করে উড়িয়ে দিয়ো কেশ।
অমনি করে নিবিড় ধারা-জলে
অমনি করে ঘন তিমির-তলে
      আমায় তুমি করো নিরুদ্দেশ।

ওগো তোমার দরশ লাগি
ওগো তোমার পরশ মাগি
      গুমরে মোর হিয়া।
রহি রহি পরান ব্যেপে
আগুন-রেখা কেঁপে কেঁপে
      যায় যে ঝলকিয়া।
আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে
বলাকা-দল যাচ্ছে উড়ে
      জানি নে কোন্‌ দূর-সমুদ্র-পারে।
সজল বায়ু উদাস ছুটে,
কোথায় গিয়ে কেঁদে উঠে
      পথবিহীন গহন অন্ধকারে।
ওগো তোমার আনো খেয়ার তরী,
তোমার সাথে যাব অকূল-'পরি,
      যাব সকল বাঁধন-বাধা-খোলা।
ঝড়ের বেলা তোমার স্মিতহাসি
লাগবে আমার সর্বদেহে আসি,
তরাস-সাথে হরষ দিবে দোলা।

ওই যেখানে ঈশান কোণে
তড়িৎ হানে ক্ষণে ক্ষণে
      বিজন উপকূলে--
তটের পায়ে মাথা কুটে
তরঙ্গদল ফেনিয়ে উঠে
      গিরির পদমূলে,
ওই যেখানে মেঘের বেণী
জড়িয়ে আছে বনের শ্রেণী--
      মর্মরিছে নারিকেলের শাখা,
গরুড়সম ওই যেখানে
ঊর্ধ্বশিরে গগন-পানে
      শৈলমালা তুলেছে নীল পাখা,
কেন আজি আনে আমার মনে
ওইখানেতে মিলে তোমার সনে
      বেঁধেছিলেম বহুকালের ঘর--
হোথায় ঝড়ের নৃত্য-মাঝে
ঢেউয়ের সুরে আজো বাজে
      যুগান্তরের মিলনগীতিস্বর।

কে গো চিরজনম ভ'রে
নিয়েছ মোর হৃদয় হ'রে
      উঠছে মনে জেগে।
নিত্যকালের চেনাশোনা
করছে আজি আনাগোনা
      নবীন-ঘন মেঘে।
কত প্রিয়মুখের ছায়া
কোন্‌ দেহে আজ নিল কায়া,
      ছড়িয়ে দিল সুখদুখের রাশি--
আজকে যেন দিশে দিশে
ঝড়ের সাথে যাচ্ছে মিশে
      কত জন্মের ভালোবাসাবাসি।
তোমায় আমায় যত দিনের মেলা
লোক-লোকান্তে যত কালের খেলা
      এক মুহূর্তে আজ করো সার্থক।
এই নিমেষে কেবল তুমি একা
জগৎ জুড়ে দাও আমারে দেখা,
      জীবন জুড়ে মিলন আজি হোক।

পাগল হয়ে বাতাস এল,
ছিন্ন মেঘে এলোমেলো
      হচ্ছে বরিষন,
জানি না দিগ্‌দিগন্তরে
আকাশ ছেয়ে কিসের তরে
      চলছে আয়োজন।
পথিক গেছে ঘরে ফিরে,
পাখিরা সব গেছে নীড়ে,
      তরণী সব বাঁধা ঘাটের কোলে।
আজি পথের দুই কিনারে
জাগিছে গ্রাম রুদ্ধ দ্বারে,
      দিবস আজি নয়ন নাহি খোলে।
শান্ত হ রে, শান্ত হ রে প্রাণ--
ক্ষান্ত করিস প্রগল্‌ভ এই গান,
      ক্ষান্ত করিস বুকের দোলাদুলি।
হঠাৎ যদি দুয়ার খুলে যায়,
হঠাৎ যদি হরষ লাগে গায় যায়,
      তখন চেয়ে দেখিস আঁখি তুলি।


  আলমোড়া, ৩০ বৈশাখ, ১৩১০
 

৩৪    


আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে,
বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
             কে জানে এই গ্রাম,
             কে জানে এর নাম,
খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে--
শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে।

বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে
কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে।
             কত আষাঢ় মাসে
             ভিজে মাটির বাসে
বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে।
সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে।

এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়,
এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়।
             এই পুকুরে তারি,
             সাঁতার-কাটা বারি,
ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়।
এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়।

এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি
এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি।
             কুশল পুছি তারে
             দাঁড়াত তার দ্বারে
লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি।
সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি।

পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে,
দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে।
             পারের যাত্রিদলে
             খেয়ার ঘাটে চলে,
কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে।


  আলমোড়া, ২৯ বৈশাখ, ১৩১০ 
 

৩৫    


ওরে আমার কর্মহারা,             ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া,
                ওরে আমার মন রে, আমার মন।
জানি নে তুই কিসের লাগিকোন্‌ জগতে আছিস জাগি--
                কোন্‌ সেকালের বিলুপ্ত ভুবন।
কোন্‌ পুরানো যুগের বাণী           অর্থ যাহার নাহি জানি
                  তোমার মুখে উঠছে আজি ফুটে।
অনন্ত তোর প্রাচীন স্মৃতি    কোন্‌ ভাষাতে গাঁথছে গীতি,
                  শুনে চক্ষে অশ্রুধারা ছুটে।
আজি সকল আকাশ জুড়ে         যাচ্ছে তোমার পাখা উড়ে,
                  তোমার সাথে চলতে আমি নারি।
তুমি যাদের চিনি ব'লে          টানছ বুকে, নিচ্ছ কোলে,
                  আমি তাদের চিনতে নাহি পারি।

আজকে নবীন চৈত্রমাসে            পুরাতনের বাতাস আসে,
                  খুলে গেছে যুগান্তরের সেতু।
মিথ্যা আজি কাজের কথা,      আজ জেগেছে যে-সব ব্যথা
                  এই জীবনে নাইকো তাহার হেতু।
গভীর চিত্তে গোপন শালা          সেথা ঘুমায় যে রাজবালা
                  জানি নে সে কোন্‌ জনমের পাওয়া।
দেখে নিলেম ক্ষণেক তারে,      যেমনি আজি মনের দ্বারে
                  যবনিকা উড়িয়ে দিল হাওয়া।
ফুলের গন্ধ চুপে চুপে           আজি সোনার কাঠি-রূপে
                  ভাঙালো তার চিরযুগের ঘুম।
দেখছে লয়ে মুকুর করে       আঁকা তাহার ললাট-'পরে
                  কোন্‌ জনমের চন্দনকুঙ্কুম।

আজকে হৃদয় যাহা কহে            মিথ্যা নহে, সত্য নহে,
                  কেবল তাহা অরূপ অপরূপ।
খুলে গেছে কেমন করে              আজি অসম্ভবের ঘরে
                  মর্চে-পড়া পুরানো কুলুপ।
সেথায় মায়াদ্বীপের মাঝে       নিমন্ত্রণের বীণা বাজে,
                  ফেনিয়ে ওঠে নীল সাগরের ঢেউ,
মর্মরিত-তমাল-ছায়ে          ভিজে চিকুর শুকায় বায়ে--
                  তাদের চেনে, চেনে না বা কেউ।
শৈলতলে চরায় ধেনু,             রাখালশিশু বাজায় বেণু,
                  চূড়ায় তারা সোনার মালা পরে।
সোনার তুলি দিয়ে লিখা              চৈত্রমাসের মরীচিকা
                  কাঁদায় হিয়া অপূর্বধন-তরে।

গাছের পাতা যেমন কাঁপে         দখিনবায়ে মধুর তাপে
                  তেমনি মম কাঁপছে সারা প্রাণ।
কাঁপছে দেহে কাঁপছে মনে   হাওয়ার সাথে আলোর সনে,
                  মর্মরিয়া উঠছে কলতান।
কোন্‌ অতিথি এসেছে গো,    কারেও আমি চিনি নে গো
                  মোর দ্বারে কে করছে আনাগোনা।
ছায়ায় আজি তরুর মূলে         ঘাসের 'পরে নদীর কূলে
                  ওগো তোরা শোনা আমায় শোনা--
দূর-আকাশের-ঘুম-পাড়ানি        মৌমাছিদের-মন-হারানি
                  জুঁই-ফোটানো ঘাস-দোলানো গান,
জলের-গায়ে-পুলক-দেওয়া   ফুলের-গন্ধ-কুড়িয়ে-নেওয়া
                  চোখের পাতে-ঘুম-বোলানো তান।

শুনাস নে গো ক্লান্ত বুকের        বেদনা যত সুখের দুখের --
                  প্রেমের কথা-- আশার নিরাশার।
শুনাও শুধু মৃদুমন্দ                    অর্থবিহীন কথার ছন্দ,
                  শুধু সুরের আকুল ঝংকার।
ধারাযন্ত্রে সিনান করি                  যত্নে তুমি এসো পরি
                  চাঁপাবরন লঘু বসনখানি।
ভালে আঁকো ফুলের রেখা             চন্দনেরই পত্রলেখা,
                  কোলের 'পরে সেতার লহো টানি।
দূর দিগন্তে মাঠের পারে         সুনীল-ছায়া গাছের সারে
                  নয়নদুটি মগ্ন করি চাও।
ভিন্নদেশী কবির গাঁথা          অজানা কোন্‌ ভাষার গাথা
                  গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া গাও।


  হাজারিবাগ, ১২ চৈত্র, ১৩০৯
 

৩৬    


আমার খোলা জানালাতে
শব্দবিহীন চরণপাতে
      কে এলে গো, কে গো তুমি এলে।
একলা আমি বসে আছি
অস্তলোকের কাছাকাছি
      পশ্চিমেতে দুটি নয়ন মেলে।
অতিসুদূর দীর্ঘ পথে
আকুল তব আঁচল হতে
      আঁধারতলে গন্ধরেখা রাখি
জোনাক-জ্বালা বনের শেষে
কখন এলে দুয়ারদেশে
      শিথিল কেশে ললাটখানি ঢাকি।

তোমার সাথে আমার পাশে
কত গ্রামের নিদ্রা আসে--
      পান্থবিহীন পথের বিজনতা,
ধূসর আলো কত মাঠের,
বধূশূন্য কত ঘাটের
      আঁধার কোণে জলের কলকথা।
শৈলতটের পায়ের 'পরে
তরঙ্গদল ঘুমিয়ে পড়ে,
      স্বপ্ন তারি আনলে বহন করি।
কত বনের শাখে শাখে
পাখির যে গান সুপ্ত থাকে
      এনেছ তাই মৌন নূপুর ভরি।

মোর ভালে ওই কোমল হস্ত
এনে দেয় গো সূর্য-অস্ত,
      এনে দেয় গো কাজের অবসান--
সত্যমিথ্যা ভালোমন্দ
সকল সমাপনের ছন্দ,
      সন্ধ্যানদীর নিঃশেষিত তান।
আঁচল তব উড়ে এসে
লাগে আমার বক্ষে কেশে,
      দেহ যেন মিলায় শূন্য'পরি,
চক্ষু তব মৃত্যুসম
স্তব্ধ আছে মুখে মম
      কালো আলোয় সর্বহৃদয় ভরি।

যেমনি তব দখিন-পাণি
তুলে নিল প্রদীপখানি,
      রেখে দিল আমার গৃহকোণে,
গৃহ আমার এক নিমেষে
ব্যাপ্ত হল তারার দেশে
      তিমিরতটে আলোর উপবনে।
আজি আমার ঘরের পাশে
গগনপারের কারা আসে
      অঙ্গ তাদের নীলাম্বরে ঢাকি।
আজি আমার দ্বারের কাছে
অনাদি রাত স্তব্ধ আছে
      তোমার পানে মেলি তাহার আঁখি।

এই মুহূর্তে আধেক ধরা
লয়ে তাহার আঁধার-ভরা
      কত বিরাম, কত গভীর প্রীতি,
আমার বাতায়নে এসে
দাঁড়ালো আজ দিনের শেষে--
      শোনায় তোমায় গুঞ্জরিত গীতি।
চক্ষে তব পলক নাহি,
ধ্রুবতারার দিকে চাহি
      তাকিয়ে আছ নিরুদ্দেশের পানে।
নীরব দুটি চরণ ফেলে
আঁধার হতে কে গো এলে
      আমার ঘরে আমার গীতে গানে।--

কত মাঠের শূন্যপথে,
কত পুরীর প্রান্ত হতে,
      কত সিন্ধুবালুর তীরে তীরে,
কত শান্ত নদীর পারে,
কত স্তব্ধ গ্রামের ধারে,
      কত সুপ্ত গৃহদুয়ার ফিরে,
কত বনের বায়ুর 'পরে
এলো চুলের আঘাত ক'রে
      আসিলে আজ হঠাৎ অকারণে।
বহু দেশের বহু দূরের
বহু দিনের বহু সুরের
      আনিলে গান আমার বাতায়নে।


  হাজারিবাগ, ১৬ চৈত্র, ১৩০৯
 

৩৭    


আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়,
      আঁধারেতে চলে যায় বাহিরে।
ভাবে মনে, বৃথা এই আসা আর যাওয়া,
      অর্থ কিছুই এর নাহি রে।
      কেন আসি, কেন হাসি,
      কেন আঁখিজলে ভাসি,
কার কথা বলে যাই, কার গান গাহি রে--
      অর্থ কিছুই তার নাহি রে।

ওরে মন, আয় তুই সাজ ফেলে আয়,
      মিছে কী করিস নাট-বেদীতে।
বুঝিতে চাহিস যদি বাহিরেতে আয়,
      খেলা ছেড়ে আয় খেলা দেখিতে।
             ওই দেখ্‌ নাটশালা
             পরিয়াছে দীপমালা,
সকল রহস্য তুই চাস যদি ভেদিতে
      নিজে না ফিরিলে নাট-বেদীতে।

নেমে এসে দূরে এসে দাঁড়াবি যখন--
      দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি,
এই হাসি-রোদনের মহানাটকের
             অর্থ তখন কিছু বুঝিবি।
                   একের সহিত একে
                   মিলাইয়া নিবি দেখে,
বুঝে নিবি, বিধাতার সাথে নাহি  যুঝিবি--
      দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি।

৩৮    


চিরকাল একি লীলা গো--
     অনন্ত কলরোল।
অশ্রুত কোন্‌ গানের ছন্দে
     অদ্ভুত এই দোল।
     দুলিছ গো, দোলা দিতেছ।
পলকে আলোকে তুলিছ, পলকে
     আঁধারে টানিয়া নিতেছ।
     সমুখে যখন আসি
     তখন পুলকে হাসি,
পশ্চাতে যবে ফিরে যায় দোলা
      ভয়ে আঁখিজলে ভাসি।
সমুখে যেমন পিছেও তেমন,
      মিছে করি মোরা গোল।
চিরকাল একই লীলা গো--
      অনন্ত কলরোল।

ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
      বাম হাত হতে ডানে।
নিজধন তুমি নিজেই হরিয়া
      কী যে কর কে বা জানে।
      কোথা বসে আছ একেলা--
সব রবিশশী কুড়ায়ে লইয়া
      তালে তালে কর এ খেলা।
      খুলে দাও ক্ষণতরে,
      ঢাকা দাও ক্ষণপরে--
মোরা কেঁদে ভাবি, আমারি কী ধন
      কে লইল বুঝি হ'রে!
দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান
      সে কথাটি কে বা জানে।
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
      বাম হাত হতে ডানে।

এইমতো চলে চির কাল গো
      শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
চির দিনরাত আপনার সাথ
      আপনি খেলিছ পাশা।
      আছে তো যেমন যা ছিল--
হারায় নি কিছু, ফুরায় নি কিছু
      যে মরিল যে বা বাঁচিল।
      বহি সব সুখদুখ
      এ ভুবন হাসিমুখ,
তোমারি খেলার আনন্দে তার
      ভরিয়া উঠেছে বুক।
আছে সেই আলো, আছে সেই গান,
      আছে সেই ভালোবাসা।
এইমতো চলে চির কাল গো
      শুধু যাওয়া, শুধু আসা।

৩৯    


সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো,
      সে কি তুমি, মোর সভাতে।
      হাতে ছিল তব বাঁশি,
      অধরে অবাক হাসি,
সেদিন ফাগুন মেতে উঠেছিল
      মদবিহ্বল শোভাতে।
সে কি তুমি ওগো, তুমি এসেছিলে
      সেদিন নবীন প্রভাতে--
      নবযৌবনসভাতে।

সেদিন আমার যত কাজ ছিল
      সব কাজ তুমি ভুলালে।
      খেলিলে সে কোন্‌ খেলা,
      কোথা কেটে গেল বেলা--
ঢেউ দিয়ে দিয়ে হৃদয়ে আমার
      রক্তকমল দুলালে।
পুলকিত মোর পরানে তোমার
      বিলোল নয়ন বুলালে,
      সব কাজ মোর ভুলালে।

তার পরে হায় জানি নে কখন
      ঘুম এল মোর নয়নে।
      উঠিনু যখন জেগে
      ঢেকেছে গগন মেঘে
তরুতলে আছি একেলা পড়িয়া
      দলিত পত্রশয়নে।
তোমাতে আমাতে রত ছিনু যবে
      কাননে কুসুমচয়নে
      ঘুম এল মোর নয়নে।

সেদিনের সভা ভেঙে গেছে সব
      আজি ঝরঝর বাদরে।
      পথে লোক নাহি আর,
      রুদ্ধ করেছি দ্বার,
একা আছে প্রাণ ভূতলশয়ান
      আজিকার ভরা ভাদরে।
তুমি কি দুয়ারে আঘাত করিলে--
      তোমারে লব কি আদরে
      আজি ঝরঝর বাদরে।

তুমি যে এসেছ ভস্মমলিন
      তাপসমুরতি ধরিয়া।
      স্তিমিত নয়নতারা
      ঝলিছে অনলপারা,
সিক্ত তোমার জটাজুট হতে
      সলিল পড়িছে ঝরিয়া।
বাহির হইতে ঝড়ের আঁধার
      আনিয়াছ সাথে করিয়া
      তাপসমুরতি ধরিয়া।

নমি হে ভীষণ, মৌন, রিক্ত,
      এসো মোর ভাঙা আলয়ে।
      ললাটে তিলকরেখা
      যেন সে বহ্নিলেখা,
হস্তে তোমার লৌহদণ্ড
      বাজিছে লৌহবলয়ে।
শূন্য ফিরিয়া যেয়ো না অতিথি,
      সব ধন মোর না লয়ে।
      এসো এসো ভাঙা আলয়ে।

৪০    


                        মন্ত্রেসে যে পূত
                        রাখীররাঙা সুতো
                     বাঁধন  দিয়েছিনু হাতে,
                     আজ কিআছে সেটি সাথে।
                বিদায়বেলা এল    মেঘের মতো ব্যেপে,
                গ্রন্থি বেঁধে দিতে  দু হাত গেল কেঁপে,
                সেদিন থেকে থেকে        চক্ষুদুটি ছেপে
                     ভরে যে এল  জলধারা।
                আজকে বসে আছি          পথের এক পাশে,
                আমের ঘন বোলে           বিভোল মধুমাসে
                তুচ্ছ কথাটুকু       কেবল মনে আসে
                     ভ্রমর যেন পথহারা--
                সেই-যে বাম হাতে         একটি সরু রাখী--
                     আধেক রাঙা, সোনা আধা,
                     আজো কি আছে সেটি বাঁধা।

                          পথ যে কতখানি
                          কিছুই নাহি জানি,
                     মাঠের গেছে কোন্‌ শেষে
                     চৈত্র-ফসলের দেশে।
                যখন গেলে চলে   তোমার গ্রীবামূলে
                দীর্ঘ বেণী তব      এলিয়ে ছিল খুলে,
                মাল্যখানি গাঁথা    সাঁজের কোন্‌ ফুলে
                     লুটিয়ে পড়েছিল পায়ে।
                একটুখানি তুমি    দাঁড়িয়ে যদি যেতে!
                নতুন ফুলে দেখো  কানন ওঠে মেতে,
                দিতেম ত্বরা করে   নবীন মালা গেঁথে
                     কনকচাঁপা-বনছায়ে।
                মাঠের পথে যেতে  তোমার মালাখানি
                     প'ল কি বেণী হতে খসে
                     আজকে ভাবি তাই বসে।

                          নূপুর ছিল ঘরে
                          গিয়েছ পায়ে প'রে--
                     নিয়েছ হেথা হতে তাই,
                     অঙ্গে আর কিছু নাই।
                আকুল কলতানে   শতেক রসনায়
                চরণ ঘেরি তব    কাঁদিছে করুণায়,
                তাহারা হেথাকার     বিরহবেদনায়
                     মুখর করে তব পথ।
                জানি না কী এত যে         তোমার ছিল ত্বরা,
                কিছুতে হল না যে           মাথার ভূষা পরা,
                দিতেম খুঁজে এনে            সিঁথিটি মনোহরা--
                     রহিল মনে মনোরথ।
                হেলায়-বাঁধা সেই  নূপুর-দুটি পায়ে
                     আছে কি পথে গেছে খুলে
                     সে কথা ভাবি তরুমূলে।

                          অনেক গীতগান
                          করেছি অবসান
                     অনেক সকালে ও সাঁজে
                     অনেক অবসরে কাজে।
                তাহারি শেষ গান           আধেক লয়ে কানে
                দীর্ঘ পথ দিয়ে      গেছ সুদূর-পানে,
                আধেক-জানা সুরে       আধেক-ভোলা তানে
                     গেয়েছ গুন্‌ গুন্‌ স্বরে।
                কেন না গেলে শুনি          একটি গান আরো--
                সে গান শুধু তব,         সে নহে আর কারো--
                তুমিও গেলে চলে            সময় হল তারো,
                     ফুটল তব পূজাতরে।
                মাঠের কোন্‌খানে  হারালো শেষ সুর
                     যে গান নিয়ে গেল শেষে,
                     ভাবি যে তাই অনিমেষে।


  হাজারিবাগ, ১০ চৈত্র, ১৩০৯
 

৪১    


পথের পথিক করেছ আমায়
      সেই ভালো ওগো, সেই ভালো।
আলেয়া জ্বালালে প্রান্তরভালে
      সেই আলো মোর সেই আলো।
      ঘাটে বাঁধা ছিল খেয়াতরী,
      তাও কি ডুবালে ছল করি।
সাঁতারিয়া পার হব বহি ভার
      সেই ভালো মোর সেই ভালো।

ঝড়ের মুখে যে ফেলেছ আমায়
      সেই ভালো ওগো, সেই ভালো।
সব সুখজালে বজ্র জ্বালালে
      সেই আলো মোর সেই আলো।
      সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি--
      কী ভয় লাগালে, গেল ছাড়ি--
একাকীর পথে চলিব জগতে
      সেই ভালো মোর সেই ভালো।

কোনো মান তুমি রাখ নি আমার
      সেই ভালো ওগো, সেই ভালো।
হৃদয়ের তলে যে আগুন জ্বলে
      সেই আলো মোর সেই আলো।
      পাথেয় যে ক'টি ছিল কড়ি
      পথে খসি কবে গেছে পড়ি,
শুধু নিজবল আছে সম্বল
      সেই ভালো মোর সেই ভালো।

৪২    


আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।
      ঘন্টা বাজিল দূরে
      ও পারের রাজপুরে,
এখনো যে পথে চলেছিস তুই
      হায় রে পথশ্রান্ত
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।

দেখ্‌ সবে ঘরে ফিরে এল, ওরে
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।
      পূজা সারি দেবালয়ে
      প্রসাদী কুসুম লয়ে,
এখন ঘুমের কর্‌ আয়োজন
      হায় রে পথশ্রান্ত
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।

রজনী আঁধার হয়ে আসে, ওরে
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।
      ওই-যে গ্রামের 'পরে
      দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে--
দীপহীন পথে কী করিবি একা
      হায় রে পথশ্রান্ত
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।

এত বোঝা লয়ে কোথা যাস, ওরে
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।
      নামাবি এমন ঠাঁই
      পাড়ায় কোথা কি নাই।
কেহ কি শয়ন রাখে নাই পাতি
      হায় রে পথশ্রান্ত
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।

পথের চিহ্ন দেখা নাহি যায়
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।
      কোন্‌ প্রান্তরশেষে
      কোন্‌ বহুদূর দেশে
কোথা তোর রাত হবে যে প্রভাত
      হায় রে পথশ্রান্ত
      পান্থ, বিদেশী পান্থ।

৪৩    


        সাঙ্গ হয়েছে রণ।
অনেক যুঝিয়া      অনেক খুঁজিয়া
        শেষ হল আয়োজন।
        তুমি এসো এসো নারী,
        আনো তব হেমঝারি।
ধুয়ে-মুছে দাও ধূলির চিহ্ন,
জোড়া দিয়ে দাও ভগ্ন-ছিন্ন,
সুন্দর করো সার্থক করো
        পুঞ্জিত আয়োজন।
        এসো সুন্দরী নারী,
        শিরে লয়ে হেমঝারি।

        হাটে আর নাই কেহ।
শেষ করে খেলা     ছেড়ে এনু মেলা,
        গ্রামে গড়িলাম গেহ।
        তুমি এসো এসো নারী,
        আনো গো তীর্থবারি।
স্নিগ্ধহসিত বদন-ইন্দু,
সিঁথায় আঁকিয়া সিঁদুর-বিন্দু
মঙ্গল করো সার্থক করো
        শূন্য এ মোর গেহ।
        এসো কল্যাণী নারী,
        বহিয়া তীর্থবারি।

        বেলা কত যায় বেড়ে।
কেহ নাহি চাহে      খররবিদাহে
        পরবাসী পথিকেরে।
        তুমি এসো এসো নারী,
        আনো তব সুধাবারি।
বাজাও তোমার নিষ্কলঙ্ক
শত-চাঁদে-গড়া শোভন শঙ্খ,
বরণ করিয়া সার্থক করো
     পরবাসী পথিকেরে।
     আনন্দময়ী নারী,
     আনো তব সুধাবারি।

     স্রোতে যে ভাসিল ভেলা।
এবারের মতো    দিন হল গত
     এল বিদায়ের বেলা।
     তুমি এসো এসো নারী,
     আনো গো অশ্রুবারি।
তোমার সজল কাতর দৃষ্টি
পথে করে দিক করুণাবৃষ্টি,
ব্যাকুল বাহুর পরশে ধন্য
      হোক বিদায়ের বেলা।
      অয়ি বিষাদিনী নারী,
      আনো গো অশ্রুবারি।

      আঁধার নিশীথরাতি।
গৃহ নির্জন,       শূন্য শয়ন,
     জ্বলিছে পূজার বাতি।
     তুমি এসো এসো নারী,
     আনো তর্পণবারি।
অবারিত করি ব্যথিত বক্ষ
খোলো হৃদয়ের গোপন কক্ষ,
এলো-কেশপাশে শুভ্র-বসনে
     জ্বালাও পূজার বাতি।
     এসো তাপসিনী নারী,
     আনো তর্পণবারি।

৪৪    


আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা,
দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা।
কোথা হতে চৈত্রমাসে             হাঁসের শ্রেণী উড়ে আসে,
অঘ্রানেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা
আমরা কিছুই জানি নেকো সেই সুদূরের কথা।
আমরা জানি গ্রাম ক'খানি, চিনি দশটি গিরি--
মা ধরণী রাখেন মোদের কোলের মধ্যে ঘিরি।

সে ছিল ওই বনের ধারে ভুট্টাখেতের পাশে
যেখানে ওই ছায়ার তলে জলটি ঝ'রে আসে।
ঝর্না হতে আনতে বারি           জুটত হোথা অনেক নারী,
উঠত কত হাসির ধ্বনি তারি ঘরের দ্বারে--
সকাল-সাঁঝে আনাগোনা তারি পথের ধারে।
মিশত কুলুকুলুধ্বনি তারি দিনের কাজে,
ওই রাগিনী পথ হারাত তারি ঘুমের মাঝে।

সন্ধ্যাবেলায় সন্ন্যাসী এক, বিপুল জটা শিরে,
মেঘে-ঢাকা শিখর হতে নেমে এলেন ধীরে।
বিস্ময়েতে আমরা সবে       শুধাই, "তুমি কে গো হবে।'
বসল যোগী নিরুত্তরে নির্ঝরিণীর কূলে
নীরবে সেই ঘরের পানে স্থির নয়ন তুলে।
অজানা কোন্‌ অমঙ্গলে বক্ষ কাঁপে ডরে--
রাত্রি হল, ফিরে এলেম যে যার আপন ঘরে।

পরদিনে প্রভাত হল দেবদারুর বনে,
ঝর্নাতলায় আনতে বারি জুটল নারীগণে।
দুয়ার খোলা দেখে আসি--       নাই সে খুশি, নাই সে হাসি,
জলশূন্য কলসখানি গড়ায় গৃহতলে,
নিব-নিব প্রদীপটি সেই ঘরের কোণে জ্বলে।      
কোথায় সে যে চলে গেল রাত না পোহাতেই,
শূন্য ঘরের দ্বারের কাছে সন্ন্যাসীও নেই।

চৈত্রমাসে রৌদ্র বাড়ে, বরফ গ'লে পড়ে--
ঝর্নাতলায় বসে মোরা কাঁদি তাহার তরে।
আজিকে এই তৃষার দিনে       কোথায় ফিরে নিঝর বিনে,
শুষ্ক কলস ভরে নিতে কোথায় পাবে ধারা।
কে জানে সে নিরুদ্দেশে কোথায় হল হারা।
কোথাও কিছু আছে কি গো, শুধাই যারে তারে--
আমাদের এই আকাশ-ঢাকা দশ পাহাড়ের পারে।

গ্রীষ্মরাতে বাতায়নে বাতাস হু হু করে,
বসে আছি প্রদীপ-নেবা তাহার শূন্য ঘরে।
শুনি বসে দ্বারের কাছে           ঝর্না যেন তারেই যাচে--
বলে, "ওগো, আজকে তোমার নাই কি কোনো তৃষা।
জলে তোমার নাই প্রয়োজন, এমন গ্রীষ্মনিশা?'
আমিও কেঁদে কেঁদে বলি, "হে অজ্ঞাতচারী,
তৃষ্ণা যদি হারাও তবু ভুলো না এই বারি।'

হেনকালে হঠাৎ যেন লাগল চোখে ধাঁধা,
চারি দিকে চেয়ে  দেখি নাই পাহাড়ের বাধা।
ওই-যে আসে, কারে দেখি--   আমাদের যে ছিল সে কি।
ওগো, তুমি কেমন আছ, আছ মনের সুখে?
খোলা আকাশতলে হেথা ঘর কোথা কোন্‌ মুখে?
নাইকো পাহাড়, কোনোখানে ঝর্না নাহি ঝরে,
তৃষ্ণা পেলে কোথায় যাবে বারিপানের তরে?

সে কহিল, "যে ঝর্না বয় সেথা মোদের দ্বারে,
নদী হয়ে সে'ই চলেছে হেথা উদার ধারে।
সে আকাশ সেই পাহাড় ছেড়ে              অসীম-পানে গেছে বেড়ে
সেই ধরারেই নাইকো হেথা পাষাণ-বাঁধা বেঁধে।'
"সবই আছে, আমরা তো নেই' কইনু তারে কেঁদে।
সে কহিল করুণ হেসে, "আছ হৃদয়মূলে।'
স্বপন ভেঙে চেয়ে দেখি আছি ঝর্নাকূলে।


  জোড়াসাঁকো, ১০ মাঘ, ১৩০৯
 

৪৫    


অত          চুপি চুপি কেন কথা কও
        ওগো   মরণ, হে মোর মরণ।
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,
     ওগো   একি প্রণয়েরি ধরন।
যবে     সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল
     পড়ে    ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া,
যবে          ফিরে আসে গোঠে গাভীদল
     সারা    দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া,
তুমি         পাশে আসি বস অচপল
     ওগো   অতি মৃদুগতি-চরণ।
আমি        বুঝি না যে কী যে কথা কও
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ।

হায়    এমনি করে কি, ওগো চোর,
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ,
চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর
     করি     হৃদিতলে অবতরণ।
তুমি         এমনি কি ধীরে দিবে দোল
     মোর    অবশ বক্ষশোণিতে।
কানে        বাজাবে ঘুমের কলরোল
     তব         কিঙ্কিণি-রণরণিতে?
শেষে        পসারিয়া তব হিম-কোল
     মোরে   স্বপনে করিবে হরণ?
আমি        বুঝি না যে কেন আস-যাও
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ।

কহ    মিলনের এ কি রীতি এই
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ।
তার         সমারোহভার কিছু নেই--
     নেই     কোনো মঙ্গলাচরণ?
তব          পিঙ্গলছবি মহাজট
     সে কি  চূড়া করি বাঁধা হবে না।
তব    বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট
     সে কি     আগে-পিছে কেহ ববে না।
তব    মশাল-আলোকে নদীতট
     আঁখি    মেলিবে না রাঙাবরন?
ত্রাসে        কেঁপে উঠিবে না ধরাতল
     ওগো   মরণ,হে মোর মরণ?

যবে          বিবাহে চলিলা বিলোচন
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ,
তাঁর         কতমতো ছিল আয়োজন,
     ছিল     কতশত উপকরণ।
তাঁর         লটপট করে বাঘছাল
     তাঁর     বৃষ রহি রহি গরজে,
তাঁর         বেষ্টন করি জটাজাল
     যত     ভুজঙ্গদল তরজে।
তাঁর         ববম্‌ববম্‌ বাজে গাল,
     দোলে  গলায় কপালাভরণ,
তাঁর         বিষাণে ফুকারি উঠে তান
     ওগো   মরণ, হে মোর মরণ।

শুনি        শ্মশানবাসীর কলকল
     ওগো  মরণ, হে মোর মরণ,
সুখে       গৌরীর আঁখি ছলছল,
     তাঁর   কাঁপিছে নিচোলাবরণ।
তাঁর        বাম আঁখি ফুরে থরথর,
     তাঁর   হিয়া দুরুদুরু দুলিছে,
তাঁর        পুলকিত তনু জরজর,
     তাঁর   মন আপনারে ভুলিছে।
তাঁর        মাতা কাঁদে শিরে হানি কর
     খেপা  বরেরে করিতে বরণ,
তাঁর        পিতা মনে মানে পরমাদ
     ওগো  মরণ, হে মোর মরণ।

তুমি        চুরি করি কেন এস চোর
     ওগো      মরণ, হে মোর মরণ।
শুধু    নীরবে কখন নিশি-ভোর,
     শুধু    অশ্রু-নিঝর-ঝরন।
তুমি        উৎসব করো সারারাত
     তব         বিজয়শঙ্খ বাজায়ে।
মোরে     কেড়ে লও তুমি ধরি হাত
     নব         রক্তবসনে সাজায়ে।
তুমি        কারে করিয়ো না দৃক্‌পাত,
     আমি     নিজে লব তব শরণ
যদি        গৌরবে মোরে লয়ে যাও
     ওগো      মরণ, হে মোর মরণ।

যদি        কাজে থাকি আমি গৃহমাঝ
     ওগো      মরণ, হে মোর মরণ,
তুমি        ভেঙে দিয়ো মোর সব কাজ,
     কোরো    সব লাজ অপহরণ।
যদি          স্বপনে মিটায়ে সব সাধ
     আমি       শুয়ে থাকি সুখশয়নে,
যদি          হৃদয়ে জড়ায়ে অবসাদ
     থাকি       আধজাগরূক নয়নে,
তবে         শঙ্খে তোমার তুলো নাদ
     করি        প্রলয়শ্বাস ভরণ--
আমি        ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ,
     ওগো        মরণ, হে মোর মরণ।

আমি        যাব যেথা তব তরী রয়
     ওগো       মরণ, হে মোর মরণ,
যেথা         অকূল হইতে বায়ু বয়
     করি        আঁধারের অনুসরণ।
যদি          দেখি ঘনঘোর মেঘোদয়
     দূর      ঈশানের কোণে আকাশে,
যদি          বিদ্যুৎফণী জ্বালাময়
     তার        উদ্যত ফণা বিকাশে,
আমি        ফিরিব না করি মিছা ভয়--
     আমি       করিব নীরবে তরণ
সেই         মহাবরষার রাঙা জল
     ওগো       মরণ, হে মোর মরণ।

৪৬    


সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে
এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে
বিনা কোনো পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে,
একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে।
আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি
কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি।
এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান
নিয়েছ, ভুবননাথ। সমস্ত এ প্রাণ
সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব
প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব
দিতেছি অঞ্জলি, তাও তব পূজাশেষে
লবে সবে তোমা সাথে মোরে ভালোবেসে
এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে।
যে প্রবাসে রাখ সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে।

নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে
বাঁধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে
বিকশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে
নব নব পুষ্পদলে; প্রেম-আকর্ষণে
যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে
উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে,
বাহিরে আসিবে ছুটি-- অন্তহীন প্রাণে
নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে
নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে,
নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে।
কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে
এক ধরাতলমাঝে শুধু একরূপে
বাঁচিয়া থাকিতে। নব নব মৃত্যুপথে
তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।

সংযোজন - উৎসর্গ    


বিজ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু
                                           করকমলেষু

বন্ধু, এ যে আমার লজ্জাবতী লতা
      কী পেয়েছে আকাশ হতে
      কী এসেছে বায়ুর স্রোতে
      পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে
             সে যে প্রাণের কথা।
      যত্নভরে খুঁজে খুঁজে
      তোমায় নিতে হবে বুঝে,
      ভেঙে দিতে হবে যে তার
             নীরব ব্যাকুলতা।
      আমার       লজ্জাবতী লতা।

বন্ধু, সন্ধ্যা এল, স্বপনভরা
             পবন এরে চুমে।
      ডালগুলি সব পাতা নিয়ে
             জড়িয়ে এল ঘুমে।
      ফুলগুলি সব নীল নয়ানে
      চুপিচুপি আকাশপানে
      তারার দিকে চেয়ে চেয়ে
             কোন্‌ ধেয়ানে রতা।
      আমার       লজ্জাবতী লতা।

বন্ধু, আনো তোমার তড়িৎ-পরশ,
             হরষ দিয়ে দাও,
      করুণ চক্ষু মেলে ইহার
             মর্মপানে চাও।
      সারা দিনের গন্ধগীতি
      সারা দিনের আলোর স্মৃতি
      নিয়ে এ যে হৃদয়ভারে
             ধরায় অবনতা--
      আমার       লজ্জাবতী লতা।

বন্ধু,  তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা
             ক্ষুদ্র তাহা নয়,
      সত্য যেথা কিছু আছে
      বিশ্ব সেথা রয়
      এই-যে মুদে আছে লাজে
      পড়বে তুমি এরি মাঝে--
      জীবনমৃত্যু রৌদ্রছায়া
             ঝটিকার বারতা।
      আমার       লজ্জাবতী লতা।


  কলিকাতা, ১৮ আষাঢ়, ১৩১৩


 

সংযোজন - ১    


        "হে পথিক, কোন্‌খানে
        চলেছ কাহার পানে।'
গিয়েছে রজনী,      উঠে দিনমণি,
        চলেছি সাগরস্নানে।
উষার আভাসে       তুষারবাতাসে
        পাখির উদার গানে
শয়ন তেয়াগি        উঠিয়াছি জাগি,
        চলেছি সাগরস্নানে।

        "শুধাই তোমার কাছে
        সে সাগর কোথা আছে।'
যেথা এই নদী       বহি নিরবধি
        নীল জলে মিশিয়াছে।
সেথা হতে রবি      উঠে নবছবি,
        লুকায় তাহারি পাছে--
তপ্ত প্রাণের           তীর্থস্নানের
        সাগর সেথায় আছে।

        "পথিক তোমার দলে
        যাত্রী ক'জন চলে।'
গণি তাহা ভাই     শেষ নাহি পাই,
        চলেছে জলে স্থলে।
তাহাদের বাতি      জ্বলে সারারাতি
        তিমির-আকাশ-তলে।
তাহাদের গান        সারা দিনমান
        ধ্বনিছে জলে স্থলে।

        "সে সাগর, কহো,তবে
        আর কত দূরে হবে।'
"আর কত দূরে'     "আর কত দূরে'
        সেই তো শুধাই সবে।
ধ্বনি তার আসে      দখিন বাতাসে
        ঘনভৈরবরবে।
কভু ভাবি "কাছে',   কভু "দূরে আছে'--
        আর কত দূরে হবে।

        "পথিক, গগনে চাহো,
        বাড়িছে দিনের দাহ।'
বাড়ে যদি দুখ       হব না বিমুখ,
        নিবাব না উৎসাহ।
ওরে ওরে ভীত      তৃষিত তাপিত
        জয়সংগীত গাহো।
মাথার উপরে        খররবিকরে
        বাড়ুক দিনের দাহ।

        "কী করিবে চলে চলে
        পথেই সন্ধ্যা হলে।'
প্রভাতের আশে      স্নিগ্ধ বাতাসে
        ঘুমাব পথের কোলে।
উদিবে অরুণ        নবীন করুণ
        বিহঙ্গকলরোলে।
সাগরের স্নান       হবে সমাধান
        নূতন প্রভাত হলে।

সংযোজন - ২    


      কী কথা বলিব বলে
      বাহিরে এলেম চলে,
দাঁড়ালেম দুয়ারে তোমার--
      ঊর্ধ্বমুখে উচ্চরবে
      বলিতে গেলেম যবে
             কথা নাহি আর।
যে কথা বলিতে চাহে প্রাণ
সে শুধু হইয়া উঠে গান।
      নিজে না বুঝিতে পারি,
      তোমারে বুঝাতে নারি,
চেয়ে থাকি উৎসুক-নয়ান।

      তবে কিছু শুধায়ো না--
      শুনে যাও আনমনা,
যাহা বোঝ, যাহা নাই বোঝ।
      সন্ধ্যার আঁধার-পরে
      মুখে আর কণ্ঠস্বরে
             বাকিটুকু খোঁজো।
কথায় কিছু না যায় বলা,
গান সেও উন্মত্ত উতলা।
      তুমি যদি মোর সুরে
      নিজ কথা দাও পুরে
গীতি মোর হবে না বিফলা।

সংযোজন - ৩    


          কত দিবা কত বিভাবরী
কত নদী নদে  লক্ষ স্রোতের
          মাঝখানে এক পথ ধরি,
          কত ঘাটে ঘাটে  লাগায়ে,
          কত সারিগান  জাগায়ে,
কত অঘ্রানে  নব নব ধানে
          কতবার কত বোঝা ভরি
          কর্ণধার হে কর্ণধার,
          বেচে কিনে কত স্বর্ণভার
কোন্‌ গ্রামে আজ   সাধিতে কী কাজ
          বাঁধিয়া ধরিলে তব তরী।

          হেথা বিকিকিনি  কার হাটে।
কেন এত ত্বরা  লইয়া পসরা,
          ছুটে চলে এরা কোন্‌ বাটে।
          শুন গো থাকিয়া  থাকিয়া
          বোঝা লয়ে যায়  হাঁকিয়া,
সে করুণ স্বরে    মন কী যে করে--
          কী ভেবে আমার  দিন কাটে।
          কর্ণধার হে কর্ণধার,
          বেচে কিনে লও  স্বর্ণভার--
হেথা কারা রয়   লহো পরিচয়,
          কারা আসে যায়  এই ঘাটে।

          যেথা হতে যাই, যাই কেঁদে।
এমনটি আর  পাব কি আবার
          সরে না যে মন  সেই খেদে।
          সে-সব কাঁদন ভুলালে,
          কী দোলায় প্রাণ  দুলালে।
হোথা যারা তীরে  আনমনে ফিরে
          আমি তাহাদের মরি সেধে।
          কর্ণধার হে  কর্ণধার,
          বেচে কিনে লও  স্বর্ণভার।
এই হাটে নামি  দেখে লব আমি--
          এক বেলা তরী রাখো বেঁধে।

          গান ধর তুমি কোন্‌ সুরে।
মনে পড়ে যায়  দূর হতে এনু,
          যেতে হবে পুন কোন্‌ দূরে।
          শুনে মনে পড়ে,  দুজনে
          খেলেছি সজনে  বিজনে,
সে যে কত দেশ  নাহি তার শেষ--
          সে যে কতকাল  এনু ঘুরে।
          কর্ণধার হে  কর্ণধার,
          বেচে কিনে লও  স্বর্ণভার।
বাজিয়াছে শাঁখ,  পড়িয়াছে ডাক
          সে কোন্‌ অচেনা  রাজপুরে।


সংযোজন - ৪    


দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়,
হে প্রভু, প্রত্যহ মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়।
ফিরেছি আপন-মনে আলসে লালসে
বিলাসে আবেশে ভেসে প্রবৃত্তির বশে
নানা পথে, নানা ব্যর্থ কাজে-- তুমি তবু
তখনো যে সাথে সাথে ছিলে মোর প্রভু,
আজ তাহা জানি। যে অলস চিন্তা-লতা
প্রচুরপল্লবাকীর্ণ ঘন জটিলতা
হৃদয়ে বেষ্টিয়া ছিল, তারি শাখাজালে
তোমার চিন্তার ফুল আপনি ফুটালে
নিগূঢ় শিকড়ে তার বিন্দু বিন্দু সুধা
গোপনে সিঞ্চন করি। দিয়ে তৃষ্ণা-ক্ষুধা,
দিয়ে দণ্ড-পুরস্কার সুখ-দুঃখ-ভয়
নিয়ত টানিয়া কাছে দিয়েছ প্রশ্রয়।


  ২৩ ফাল্গুন, ১৩০৭
 

সংযোজন - ৫    


রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি
বাহিরে দাঁড়ানু এসে ক্ষণেকের লাগি।
শান্ত মৌন নগরীর সুপ্ত হর্ম্য-শিরে
হেরিনু জ্বলিছে তারা নিস্তব্ধ তিমিরে।
ভূত ভাবী বর্তমান একটি পলকে
মিলিল বিষাদস্নিগ্ধ আনন্দপুলকে
আমার অন্তরতলে; অনির্বচনীয়
সে মুহূর্তে জীবনের যত-কিছু প্রিয়,
দুর্লভ বেদনা যত, যত গত সুখ,
অনুদ্‌গত অশ্রুবাষ্প, গীত মৌনমূক
আমার হৃদয়পাত্রে হয়ে রাশি রাশি
কী অনলে উজ্জ্বলিল। সৌরভে নিশ্বাসি
অপরূপ ধূপধূম উঠিল সুধীরে
তোমার নক্ষত্রদীপ্ত নিঃশব্দ মন্দিরে।

সংযোজন - ৬    


কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে
গাহিতে তোমার গান কহিল সকলে
সহসা রুধিয়া গেল হৃদয়ের দ্বার--
যেথায় আসন তব, গোপন আগার।
স্থানভেদে তব গান-- মূর্তি নব নব--
সখাসনে হাস্যোচ্ছ্বাস সেও গান তব,
প্রিয়াসনে প্রিয়ালাপ, শিশুসনে খেলা--
জগতে যেথায় যত আনন্দের মেলা
সর্বত্র তোমার গান বিচিত্র গৌরবে
আপনি ধ্বনিতে থাকে সরবে নীরবে।
আকাশে তারকা ফুটে, ফুলবনে ফুল,
খনিতে মানিক থাকে-- হয় নাকো ভুল।
তেমনি আপনি তুমি যেখানে যে গান
রেখেছ, কবিও যেন রাখে তার মান।

সংযোজন - ৭    


নানা গান গেয়ে ফিরি নানা লোকালয়;
হেরি সে মত্ততা মোর বৃদ্ধ আসি কয়,
"তাঁর ভৃত্য হয়ে তোর এ কী চপলতা।
কেন হাস্য-পরিহাস, প্রণয়ের কথা,
কেন ঘরে ঘরে ফিরি তুচ্ছ গীতরসে
ভুলাস এ সংসারের সহস্র অলসে।'
দিয়েছি উত্তর তাঁরে, "ওগো পক্ককেশ,
আমার বীণায় বাজে তাঁহারি আদেশ।
যে আনন্দে যে অনন্ত চিত্তবেদনায়
ধ্বনিত মানবপ্রাণ, আমার বীণায়
দিয়েছেন তারি সুর-- সে তাঁহারি দান।
সাধ্য নাই নষ্ট করি সে বিচিত্র গান।
তব আজ্ঞা রক্ষা করি নাই সে ক্ষমতা,
সাধ্য নাই তাঁর আজ্ঞা করিতে অন্যথা।'

সংযোজন - ৮    


বিরহবৎসর-পরে মিলনের বীণা
তেমন উন্মাদ-মন্দ্রে কেন বাজিলি না।
কেন তোর সপ্তস্বর সপ্তস্বর্গপানে
ছুটিয়া গেল না ঊর্ধ্বে উদ্দাম-পরানে
বসন্তে-মানস-যাত্রী বলাকার মতো।
কেন তোর সর্ব তন্ত্র সবলে প্রহত
মিলিত ঝংকার-ভরে কাঁপিয়া কাঁদিয়া
আনন্দের আর্তরবে চিত্ত উন্মাদিয়া
উঠিল না বাজি। হতাশ্বাস মৃদুস্বরে
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া লাজে শঙ্কাভরে
কেন মৌন হল। তবে কি আমারি প্রিয়া
সে পরশ-নিপুণতা গিয়াছে ভুলিয়া।
তবে কি আমারি বীণা ধূলিচ্ছন্ন-তার
সেদিনের মতো ক'রে বাজে নাকো আর।


  শিলাইদহ, ২১ আষাঢ়, ১৩০৩
 

সংযোজন - ৯    


ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী,
লুব্ধ বাহু বাড়াইয়া উচ্ছ্বসি উল্লসি
আমারে কি পেতে চাস চির আলিঙ্গনে।
শুধু এক মুহূর্তের উন্মত্ত মিলনে
তোর বক্ষোমাঝে চাস করিতে বিলয়
আমার বক্ষের যত সুখ দুঃখ ভয়?
আমিও তো কতদিন ভাবিয়াছি মনে
বসি তোর তটোপান্তে প্রশান্ত নির্জনে,
বাহিরে চঞ্চলা তুই প্রমত্তমুখরা,
শানিত অসির মতো ভীষণ প্রখরা,
অন্তরে নিভৃত স্নিগ্ধ শান্ত সুগম্ভীর--
দীপহীন রুদ্ধদ্বার অর্ধরজনীর
বাসরঘরের মতো নিষুপ্ত নির্জন--
সেথা কার তরে পাতা সুচির শয়ন।

সংযোজন - ১০    


অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে--
এবার কিছু কি, কবি করেছ সঞ্চয়।
ভরেছ কি কল্পনার কনক-অঞ্চলে
চঞ্চলপবনক্লিষ্ট শ্যাম কিশলয়,
ক্লান্ত করবীর গুচ্ছ। তপ্ত রৌদ্র হতে
নিয়েছ কি গলাইয়া যৌবনের সুরা--
ঢেলেছ কি উচ্ছলিত তব ছন্দঃস্রোতে,
রেখেছ কি করি তারে অনন্তমধুরা।
এ বসন্তে প্রিয়া তব পূর্ণিমানিশীথে
নবমল্লিকার মালা জড়াইয়া কেশে
তোমার আকাঙক্ষাদীপ্ত অতৃপ্ত আঁখিতে
যে দৃষ্টি হানিয়াছিল একটি নিমেষে
সে কি রাখ নাই গেঁথে অক্ষয় সংগীতে।
সে কি গেছে পুষ্পচ্যুত সৌরভের দেশে।

সংযোজন - ১১    


হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে
কে তোমারে আন্দোলিছে বিরাট মন্থনে
অনন্ত বরষ ধরি। দেবদৈত্যদলে
কী রত্ন সন্ধান লাগি তোমার অতলে
অশান্ত আবর্ত নিত্য রেখেছে জাগায়ে
পাপে-পুণ্যে সুখে-দুঃখে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়
ফেনিল কল্লোলভঙ্গে। ওগো, দাও দাও
কী আছে তোমার গর্ভে-- এ ক্ষোভ থামাও।
তোমার অন্তরলক্ষ্মী যে শুভ প্রভাতে
উঠিবেন অমৃতের পাত্র বহি হাতে
বিস্মিত ভুবন-মাঝে, লয়ে বরমালা
ত্রিলোকনাথের কণ্ঠে পরাবেন বালা,
সেদিন হইবে ক্ষান্ত এ মহামন্থন,
থেমে যাবে সমুদ্রের রুদ্র এ ক্রন্দন।


  আলমোড়া, ২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০
 
 

সংযোজন - ১২    


হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে
     শুন এ কবির গান।
তোমার চরণে নবীন হর্ষে
     এনেছি পূজার দান।
এনেছি মোদের দেহের শকতি
এনেছি মোদের মনের ভকতি,
এনেছি মোদের ধর্মের মতি,
     এনেছি মোদের প্রাণ।
এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য
     তোমারে করিতে দান।

কাঞ্চন-থালি নাহি আমাদের,
     অন্ন নাহিকো জুটে
যা আছে মোদের এনেছি সাজায়ে
     নবীন পর্ণপুটে।
সমারোহে আজ নাই প্রয়োজন,
দীনের এ পূজা, দীন আয়োজন,
চিরদারিদ্র৻ করিব মোচন
     চরণের ধুলা লুটে।
সুরদুর্লভ তোমার প্রসাদ
     লইব পর্ণপুটে।

রাজা তুমি নহ, হে মহাতাপস,
     তুমিই প্রাণের প্রিয়।
ভিক্ষাভূষণ ফেলিয়া পরিব
     তোমারি উত্তরীয়।
দৈন্যের মাঝে আছে তব ধন,
মৌনের মাঝে রয়েছে গোপন
তোমার মন্ত্র অগ্নিবচন--
     তাই আমাদের দিয়ো।
পরের সজ্জা ফেলিয়া পরিব
     তোমার উত্তরীয়।

দাও আমাদের অভয়মন্ত্র
     অশোকমন্ত্র তব।
দাও আমাদের অমৃতমন্ত্র,
     দাও গো জীবন নব।
যে জীবন ছিল তব তপোবনে
যে জীবন ছিল তব রাজাসনে
মুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবন
     চিত্ত ভরিয়া লব।
মৃত্যুতরণ শঙ্কাহরণ
     দাও সে মন্ত্র তব।

সংযোজন - ১৩    


নব বৎসরে করিলাম পণ--
           লব স্বদেশের দীক্ষা,
তব আশ্রমে তোমার চরণে
           হে ভারত, লব শিক্ষা।
পরের ভূষণ পরের বসন
তেয়াগিব আজ পরের অশন;
যদি হই দীন, না হইব হীন,
           ছাড়িব পরের ভিক্ষা।
নব বৎসরে করিলাম পণ--
           লব স্বদেশের দীক্ষা।

না থাকে প্রাসাদ, আছে তো কুটির
           কল্যাণে সুপবিত্র।
না থাকে নগর, আছে তব বন
           ফলে ফুলে সুবিচিত্র।
তোমা হতে যত দূরে গেছি সরে
তোমারে দেখেছি তত ছোটো করে;
কাছে দেখি আজ হে হৃদয়রাজ,
           তুমি পুরাতন মিত্র।
হে তাপস, তব পর্ণকুটির
           কল্যাণে সুপবিত্র।

পরের বাক্যে তব পর হয়ে
           দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।
তোমারে ভুলিতে ফিরায়েছি মুখ,
           পরেছি পরের সজ্জা।
কিছু নাহি গণি কিছু নাহি কহি
জপিছ মন্ত্র অন্তরে রহি--
তব সনাতন ধ্যানের আসন
           মোদের অস্থিমজ্জা।
পরের বুলিতে তোমারে ভুলিতে
           দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।

সে-সকল লাজ তেয়াগিব আজ,
           লইব তোমার দীক্ষা।
তব পদতলে বসিয়া বিরলে
           শিখিব তোমার শিক্ষা।
তোমার ধর্ম, তোমার কর্ম,
তব মন্ত্রের গভীর মর্ম
লইব তুলিয়া সকল ভুলিয়া
           ছাড়িয়া পরের ভিক্ষা।
তব গৌরবে গরব মানিব,
           লইব তোমার দীক্ষা।

Socializer Widget By Blogger Yard
SOCIALIZE IT →
FOLLOW US →
SHARE IT →

0 comments:

Post a Comment