Subscribe For Free Updates!

We'll not spam mate! We promise.

Friday, 14 November 2014

ঘুমনেই

অদ্বৈধ

ঘুমের ঘোর ভাঙল?দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য;
ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য
এখনো বিপদ অগ্রাহ্য?
পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী
দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব
স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য।
রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন
হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ,
একলা গহন পথে চলতে
জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ।
জীবন ললিত নয় আজকে
ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা,
বিফল স্রোতের পিছুটানকে
শরণ করেছে ভীরু সত্তা।
তবু আজ রক্তের নিদ্রা,
তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য;
সহসা চমক লাগে চিত্তে
দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ!
নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈদ
নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর,
বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা
জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর।
দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন
নতুন, নতুনতর বিশ্ব,
তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য।।


অনন্যোপায় 

অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার,
নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার,
অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান,
চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান।
যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়।
উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়।
বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ,
নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ।
আজকে ভাঙার স্বপ্ন- অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার,
বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর।
তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল,
রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল।
নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে,
উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।।




অবৈধ
আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল
উত্তর মহাসাগরের কূলে
আমার স্বপ্নের ফুলে
তারা কথা কয়েছিল
অস্পষ্ট পুরনো ভাষায়
অস্ফুট স্বপ্নের ফুল
অসহ্য সূর্যের তাপে
অনিবার্য ঝরেছিল
মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্ হতাশায়
হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া
সেদিন আর নেই-
নেই আর সূর্য-বিকিরণ
আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ!
শুনি নি স্বপ্নের ডাকঃ
থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক
বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে।
সহসা একদিন
আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেইদিন বসন্তের পাখি
উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত
আজ মনে হয়
হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে,
কী রে সম্ভব হল
আমার রক্তকে ভালবাসা!
সূর্যের কুয়াশা
এখনো কাটে নি
ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা।
মুহূর্তের সোনা
এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়,
এরই মদ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর
কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর,
অন্যমনে কী দুর্ঘটনা-
হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা।




অভিবাদন
হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা
ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা
দিকে দিকে উদ্যাপন করছে লগ্ন,
পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন
আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন,
মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ
ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা,
ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা
স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য,
বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ!
হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান?
দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান
বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী
আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি;
তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন
হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।


অলক্ষ্যে
আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর;
ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর,
এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির;
নিভেছে প্রদূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ;
স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর-
অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ;
উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা,
অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর
গলিত স্মৃতির বাস্প সেদিনের পল্লব শাখায়
বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়;
বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত।
আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে
অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত
তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে।
 

আমরা এসেছি
কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।
দুঃখ-যুগের দারায় দারায়
যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়
তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল।
তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল-
কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল,
তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল।
আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা
হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা,
হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল
তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল-
আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল
জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল।
উধাও আলোর নিচে সমারোহ ,
মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ!
ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল!
সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল-
একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল,
দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল।
সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার,
থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়,
ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল।
আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।


উদ্বীক্ষণ
নগরে গ্রামে জমেছে ভিড়
ভগ্ননীড়,-
ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়।
সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল,
কী উচ্ছল,
তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল।
কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে;
দাঁতে নখে-
জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে।
তবু সমুদ্র সীমানা রাখে,
দুর্বিপাকে
দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে।
আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময়
যে বিস্ময়
ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়?
দেশে বিদেশে লাগে জোয়ার,
ঘোড়সোয়ার
চিনে নেবে দৃঢ় লোহার,
যে পথে নিত্য সূর্যোদয়
আনে প্রলয়,
সেই সীমান্তে বাতাস বয়;
তাই প্রতীক্ষা- ঘনায় দিন
স্বপ্নহীন।


একুশে নভেম্বরঃ ১৯৪৬
আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর-
আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল
                                   
মুত্যুকাঁপানো ঝড়।
আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে
সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে
হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে
প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর।
আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।
পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল,
ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল;
বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে-
বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে।
শোন্ রে বিদেশী, শোন্
আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ।
আমরা সবাই অসভ্য, বুনো-
বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো
একপা পিছিয়ে দুপা এগোনোর
           
আমরা করেছি পণ,
কে শিখলাম
তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন।
আহ্বান আসে অনেক দূরের,
হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের,
আজ প্রয়োজন একটি সুরের
                         
একটি কঠোর স্বরঃ
দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর।
ডাক ওঠে, ডাক ওঠে-
আবার কঠোর বহু হরতালে
আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে
এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে।
নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে।
আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়,
অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম
তবু বাঁচবার শপথ নিলুম
কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়!
ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়।
আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী,
            
দাঁতে দাঁত চেপে
           
হাতে হাত চেপে
                       
উদ্যত সারি সারি ,
কিছু না হলেও আবার আমরা
                                    
রক্ত দিতে তো পারি?
পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি।
নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।

কবিতার খসড়া
আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়
কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়
ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়,
            
জানে না কেউ।
উদ্যমহীন মূঢ় কারায়
পুরনো বুলির মাছি তাড়ায়
যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায়
স্মৃতির ফেউ।


কবে
অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চুতুর্দিক,
আজো বেঁচে আছি মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক।
দুলে ওঠে দিন; শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া,
হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া।
^লে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ,
নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত।
মূঢ় ইতিহাস; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি।
সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি?
জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা
দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন রাত্রি দিয়েই ঘেরা।
তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়,
ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয়।
সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার,
এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার?
 

চিরদিনের
এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে
এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা,
সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা
জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি
দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া,
পচা জল আর মশায় অহংকারী
নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া
গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস
বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে,
গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস
গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে
রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে
কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ;
বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে
সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত
দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে
গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে,
কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে
প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে
রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে
ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে,
কেমন রে সে আকালেতে গতবারে,
চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে
এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে
কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে,
সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে
একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে
হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে
কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে,
ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে,
সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।


ছুরি
বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন,
আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য,
শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি,
দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি।
হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত,
দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত।
বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদয়-বৃন্তে
সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে।
শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য
গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য।
ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ,
তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ,
শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণঃ
এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য।
বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপ,
জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য।
বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী,
এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী।

 

জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে
             
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী;
আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে
             
বজ্রের কানাকানি।
সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে
             
শান্তি পালাল আজ।
দিন রাত্রি হল অস্থির
             
কাজ, আর শুধু কাজ!
জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর
             
হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর
             
ওঠে তার গর্জন-
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
হাজার হাজার শহীদ বীর
স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর
             
ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন।
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ
             
কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্‌;
প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার,
অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার
             
দ্বার ভাঙা আজ পণ;
এতদিন রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
             
আজো রোমাঞ্চকর;
ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়
             
কে আছে আজকে ওদের ফিরায়
কে ভাবে ওদের পর?
ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়!
নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে
ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে
             
ওদের ফিরাব কবে?
কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
             
শৃঙ্খল গত হবে?
কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে
কোটি জনতার জোয়ারের জলে
             
ভেসে যাবে কারাগার।
কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার?
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি;
ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,
বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে
             
গোপনে করেছে ঋণী।
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!
             
হে খাতক নির্বোধ,
রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ!
শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,
             
শোনো স্বদেশের ভাই,
রক্তের বিনিময় হয় হোক
             
আমরা ওদের চাই।


জনরব
পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে,
ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে,
আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো,
পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো।
স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান-
পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান;
আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে
রুদ্ধ ঘরে সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে,
হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল,
মুক্তির অবাদ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল;
স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে,
আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে,
নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা,
তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা
জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা.
দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা;
এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ বলে রে থাকি ঘৃণা,
আলোর খবর এরা কি রে যে পায় তা জানি না।
এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে,
অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলেঃ
হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ,
চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ।
অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পঞ্চজন্যধ্বনি,
দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটছে তখনি,
মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ
তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ?
জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ?
ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস।
পখিদের মাতামাতি; বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব,
যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব।
 

দিক্প্রান্তে
ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে;
অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে,
অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে
উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে,
দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে
বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে
নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে
পশেছে আঁদার রাত্রে- প্রত্যেক স্নায়ুতে;-
গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে
আরক্তিম আদিম প্রদোষে।
দিনের নীলাভ শেষ আলো
জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে।
অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানেক্ষেতে
সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল;
দিক্প্রান্তে সূর্য চমকাল।


দিনবদলের পালা
আর এক যুদ্ধ শেষ,
পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ।
উদ্দাম ঢাকের শব্দে
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে,
নামে এক ক্লান্তির জড়তা।
রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে
নাড়া দেয় পৃথিবীকে,
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
তুষারখচিত মাঠে,
ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে
অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়,
ভাঙা কামানের মুখে
ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসাঃ
কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর?
দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন!
বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন
তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন,
হাতে হিসেবের খাতা
উন্মুখর এই পৃথিবীঃ
আজ তার শোধ করো ঋণ।
অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার,
আজ হোক তোমার বিচার।
তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ,
তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান;
জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল,
পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল,
স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম,
প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম,
বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম,
দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম।
তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ
সে কেবল আমাদের বিরাট মায়।
এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক,
গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক;
সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী,
আমরা প্রহর শুধু গনি।
পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালাঃ
ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য জয়মালা;
জানো না এখানে যুদ্ধ-শুরু দিনবদলের পালা।

 

দেওয়ালী
 (ভূপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য-কে)
তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা
পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা,
আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব,
রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব।
এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি,
মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী,
সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতঃ
এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা;
তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে
কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে
পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে।
যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে,
তবুও নতুন রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ,
মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক,
দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে?
আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে,
আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই-
শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই।


নিভৃত
অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল
রচে গেল ভুল;
তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর
তাদের বিভিন্ন নয় স্তর,
অনন্তর
তারাই তাদের সৃষ্টিতে
অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে
একই কারুকার্যে নিয়মিত
উত্তপ্ত গলিত
ধাতুদের পরিচয় দিত।
শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ।
তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত
শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস,
অকল্পেয় পরিহাস
সুদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস
যেখানে হিমের রাজ্য ছিল,
যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও
সেখানেও ধানের মঞ্জরী
প্রাণের উত্তাপে ফোটে, বিচ্ছিন্ন শর্বরী;
সূর্য-সহচরী!
তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন
চিরন্তন
লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে
পৃথিবীকে
একাগ্রতায় নিলো লিখে।
সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায়
কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায়।
ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক,
বিফল চীৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক
পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক।
 

নিভৃত
বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো
আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়,
সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো,
শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।
নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে
যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব।
নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে,
অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ?
জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা
কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী,
আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা
মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।


Socializer Widget By Blogger Yard
SOCIALIZE IT →
FOLLOW US →
SHARE IT →

0 comments:

Post a Comment